কলেজের সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম শেষ করতে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম কলেজ থেকে। নাটকে অভিনয় করার কথা ছিল কিন্তু স্যাররা অভিনয় করতে দিল না কস্টিউম পরে যাইনি বলে।
কলেজ থেকে বের হয়ে সিএনজিতে উঠব, এমন সময় নক দিল নিশু। তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। লম্বা পথ। এর আগে একবার গিয়েছিলাম। তবে খুব একটা পরিচিত নয় ওই জায়গা আমার। পথটা খুবই নির্জন। রওনা দিলাম তার উদ্দেশে। সিএনজিতে উঠলাম আর কোনো যাত্রী ছিল না সেখানে। ড্রাইভার বলল, তার মা খুব অসুস্থ তাই সে তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। আমিও এবার ফোনের দিকে মনোযোগ দিলাম। মেসেজ চলছে নিশুর সঙ্গে, কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা নারিকেল গাছে মধ্যে আটকে গেছে একটা শিশুর পা। কী চিৎকার করে কাঁদছে সে। কিন্তু আশপাশে কেউ নেই। দুজন লোক তার পা কাটছে তাকে বের করার জন্য সেই আটকে যাওয়া স্থান থেকে। কিন্তু কারও চোখে কোনো চিন্তার ভাঁজ নেই, নেই হাহাকার। শিশুটির লাল রক্ত তাদের চোখ কিংবা শরীরকে লাল করতে পারেনি। সিএনজি ড্রাইভার নামতে চেয়েও নামেনি। আমিও একবার ফোন তুলে দেখার পর আর দেখিনি, দেখার সাহসও হয়নি।
সিএনজি তার গন্তব্যে গিয়ে থামল। আমি নেমে ভাড়াটা দেব তখন ড্রাইভার বলল, না ভাই টাকা লাগবে না। আমি তাড়াহুড়োয় আমার এলাকায় চলে আসছি। আপনি আপনার গন্তব্যে চলে যান। তারপর সে চলে গেল। তখন আমিও তাকিয়ে দেখলাম। এ তো আমার গন্তব্য নয়। কয়েকটা দোকান এখানে। জায়গার নাম করাকুন। দোকানের আশপাশেই আবার কিছু ঘর। যেন নিজস্ব একটি পাড়া। শুনসান নীরবতা। কথাবার্তা কেউ কিছু বলে না। কারও মুখে হাসির চাপ বিন্দু মাত্রও নেই। এটি তাদের একটি পাড়ার মতো নিজেদের বাড়ি, ঘর, দোকান সব এখানে। হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এ কোন জায়গায় এসেছি। কীভাবে চলে আসলাম। সেই শিশুটির অবস্থা দেখার পর থেকে বাকি পথ আমার আর কিছু মনে নেই। ঘুমিয়ে ছিলাম? তাও মনে পড়ছে না। আমি হেঁটে হেঁটে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। কীভাবে আমি পৌঁছাতে পারব কাসুকা বাজার। এক নারীকেও জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু কেউ যথাযোগ্য উত্তর দিল না। এবার ভয় পেয়ে বুঝতে পারলাম আমি কোনো বিপদে পড়েছি, মহাবিপদ।
নিজের ফোনটা বের করে ফেসবুকে লাইভ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোভাবেই লাইভ করতে পারলাম না। লাইভ বাটনই খুঁজে পাই না আমি। এবার চেয়েছি নিশুকে ভয়েস মেসেজ দেব। কিন্তু নিশু আমাকে ব্লক করে রেখেছে। কিন্তু কেন? উত্তর খোঁজার মতো মানসিকতা আমার নেই। উপায়ান্তর না পেয়ে সাহায্য চেয়ে একটা ভয়েস মেসেজ পাঠালাম আমার একটা সংগঠনের সিনিয়র রায়ান ভাইয়ের কাছে। কিন্তু তিনিও সিন করলেন না আমার মেসেজ।
ইতোমধ্যে আমিও হাঁটা শুরু করলাম করাকুনপাড়া থেকে বের হওয়ার রাস্তা ধরে। বেরিয়ে দেখি দুই দিকে দুই রাস্তা। কোন দিকে যাব এবার। একজনকে পেলাম। তাকে বললাম, কোন রাস্তায় গেলে কাসুকা বাজারের গাড়ি পাব। সে কোনো উত্তর দিল না। এরা কি বোবা? নাকি বোবা জিনের পাড়া এটি। আরও ভয় পেয়ে গেলাম। লোকটি আমায় কিছু না বললেও চোখের ইশারায় কাকে যেন কিছু একটা বলল। আমি ডান দিকের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। লোকটির চোখের ইশারায় দানবের মতো ছয়জন লোক রাস্তার পাশ থেকে লাফিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওত পেতে ছিল তারা এটা আমার বোঝার বাকি রইল না তাদের হাতের অস্ত্র দেখে। আমি কাল বিলম্ব না করে উল্টো দিকে দৌড়ানো শুরু করলাম। তারা কী চায় আমার কাছে? আমার টাকা, মোবাইল? নাকি আমাকে? কোনো উত্তর মিলাতে পারি না। তারাও আমাকে ধরতে দৌড়াচ্ছে আমার পিছু পিছু। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর দেখলাম একটা পাড়ার মুখে একটা ক্রেন, মাইক্রো গাড়িকে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু দৌড়াতে গিয়ে দেখি আরেকটি পাড়ার সামনের খালে প্রবাহিত হচ্ছে রক্তের স্রোত। এরপর আমি বুঝতে পারলাম আমাকে বাঁচতে হবে।
দৌড়াতে গিয়ে একটা গাড়ি পেলাম। সেখানে লাফ দিয়ে উঠে দেখি চারজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাদের মধ্যে দুজন দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজ করে। যেখানে আমিও কাজ করি। স্বস্তি পেলাম কিছুটা মনে। তাদের বললাম। আমিও কাজ করি সেসব সংগঠনে, এখন বিপদে আছি। উদ্ধার করুন। তারা কিছু বলল না। ইশারায় বলল, বসো। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর থেমে গেল। একটা রেলস্টেশনে আমরা পৌঁছে গেছি। আমার ভয় কাটতে শুরু করল আস্তে আস্তে। ট্রেন আসলে আমি চলে যেতে পারব কোথাও। অন্তত এমন ভয়ংকর জায়গা, ভয়ংকর মানুষ থেকে বেঁচে যাব। কিন্তু রেলস্টেশনও বেশ নিরিবিলি। আমরা পাঁচজন ছাড়া আর কেউ নেই। ইতোমধ্যে আমাকে ধাওয়া করতে থাকা সে ছয়জনও হাজির হয়ে গেল স্টেশনে। আমি ভদ্রলোকদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে আমারই সগোত্রীয় একজন তাদের ইশারা দিয়ে বলল, আমাকে ধরে নিয়ে যেতে। আমি যেন আর ভাবারও সুযোগ পেলাম না। আবারও দৌড় দেওয়া শুরু করলাম রেল পথ ধরে। কিন্তু বাঁচতে কি পারব? জানা নেই!
এ এস এম সায়েম
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ
তারেক