ঢাকা ১৬ বৈশাখ ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
English
মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

পাঠাগারে বই বিলি করেন তিনি

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ পিএম
পাঠাগারে বই বিলি করেন তিনি
ছবি: লেখক

যুক্তরাষ্ট্রের ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি তার একটি উক্তিতে বলেছেন, ‘উপর মহলের মানুষ থেকে আমরা খুব কমই উপহার পাই। এগুলো আসে নিচু স্তরের মানুষের কাছ থেকে’। উক্তিটি পর্যালোচনা করলে এমন অসংখ্য মানুষের চেহারা ভেসে উঠবে আমাদের চোখে। বড় বড় দালান আর বাড়ি-গাড়ি থাকলেই মানুষ মহৎ হয় না, যদি মানুষের আদর্শ ঠিক না থাকে।

মানুষকে বইমুখী করতে বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের পরিচালক, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যা করেছেন তা বইপ্রেমীরা আজীবন মনে রাখবেন। সমাজকে আলোকিত করতে মানুষকে বইয়ের দিকে অগ্রসর করতে এরপর যাদের নাম আসবে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই নিম্নমধ্যবিত্ত। মানুষগুলো দারিদ্র্য আর কষ্টে নিমজ্জিত হলেও তাদের স্বপ্ন ছিল সমাজকে সুন্দর করার। যাদের মধ্যে আছে, একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণিজন বইয়ের ফেরিওয়ালা পলান সরকার। যিনি রাজশাহীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ২০টিরও গ্রামে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। গুণী এই মানুষ ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করলেও পরবর্তী সময়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আরেক গুণিজনের ভালো কাজটি। যিনি বইপ্রেমীদের কাছে ‘বেচি দই কিনি বই’ নামে সুপরিচিত মানুষ। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিয়াউল হক। যাকে ইতোমধ্যে সামাজিক কাজে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। 

নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ ছাড়াও সামাজিক কাজকর্মে ধনী শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি আমাদের চোখে ভেসে না উঠলেও বংশপরম্পরায় ভালো মানুষের সন্ধান মিলে। তেমনি একজন মানুষ হলেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। যিনি কারও কাছে বইবন্ধু কারও কাছে বইয়ের ফেরিওয়ালা নামে পরিচিত। তবে তার কাজ সবার চাইতে আলাদা। কেউ কেউ পাঠাগার তৈরি করে মানুষকে বইমুখী করার চেষ্টা করছে আবার কেউ কেউ পাঠাগারে বই বিলি করছেন। কাজী এমদাদুল হক খোকন তাদেরই একজন। তবুও উনি সবার চাইতে ভিন্ন। বাংলাদেশের পাঁচ শতাধিকেরও বেশি পাঠাগারে নিজস্ব অর্থায়নে বই বিলি করেন তিনি।

কাজী এমদাদুল হক খোকনের দেশের বাড়ি শরীয়তপুরে। জন্ম ১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহে। বাবা ময়মনসিংহে চাকরি করার সুবাদে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন এই জেলাতেই। বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। বিএ পাস করেন শরীয়তপুরের ডামুড্যা কলেজ থেকে। পৈতৃক বসতবাড়ি ডামুড্যা উপজেলার কনেশ্বর ইউনিয়নের প্রিয়কাটি গ্রামে। শিক্ষাজীবন পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন স্টেনোগ্রাফার হিসেবে। অবসরে যান ২০১৫ সালে। শরীয়তপুর দেশের বাড়ি হলেও মিরপুরে থাকেন ভাড়া বাসায়। তার বাবা জীবিত থাকাকালীন থাকে পরামর্শ দেন নিজেকে যেন সব সময় ভালো কাজে জড়িয়ে রাখেন। সেই থেকে তিনি মানুষের পরোপকারী বন্ধু। মানুষকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার পাশাপাশি ২০১৬ সাল থেকে গ্রাম থেকে শহরে দেশের নানা প্রান্তে নিজস্ব অর্থায়নে বই বিলি করছেন। এমদাদের বাবা কাজী আব্দুল গণী ১৯৮০ সাল মৃত্যুবরণ করেন। মাতা আবেদা খাতুন মারা যান ২০১০ সালে। এরপর থেকে তিনি বাবার কথায় নিজেকে ভালো কাজে জড়িয়ে রেখেছেন। ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীসহ পারিবারিক সদস্য মোট চারজন। ছেলেমেয়ে দুজনেই পড়াশোনা করছেন। বইবন্ধুর সময় কাটে নামাজ আর বই বিলি করেই। 

বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী পাঠাগারের সংখ্যা কম থাকলেও তার সহযোগিতা আর বই পেয়ে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নতুন নতুন পাঠাগার। একেক পাঠাগারে বই দিয়েছেন পাঁচ শতাধিকেরও বেশি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন পাঠাগারে অবিরত বই পাঠিয়ে চলছেন। পাঠাগারের বইয়ের চাহিদা আর পাঠকের বই শূন্যতা পূরণে পাঠাগারপ্রেমীদের অপর নাম কাজী এমদাদুল হক। এ পর্যন্ত দেশের ৫২০টি পাঠাগারে বই পাঠিয়েছেন ৩০ হাজারের মতো। যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ লক্ষাধিক টাকা। এক পাঠাগারেই দিয়েছেন ৩ হাজার বই।

ময়মনসিংহের রানীগঞ্জ পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি রোবায়েত হোসেন বলেন, আমাদের পাঠাগারে ৫ হাজারেরও বেশি বই থাকলেও ৩ হাজারই দিয়েছেন কাজী এমদাদুল হক খোকন। পাশাপাশি দিয়েছেন নগদ অর্থ সহায়তা। তিনি আরও বলেন, তার বই পেয়েই আজ রানীগঞ্জ পাঠাগার একটি সমৃদ্ধশীল পাঠাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। স্যারের মতো মানুষ আছেন বলেই আমরা ভরসা পাই সামাজিক কাজ করতে। ঝালকাঠি সদরে অবস্থিত নারায়ণ মিস্ত্রি গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ চন্দ্র হালদার বলেন, এমদাদ ভাইয়ের মতো এমন মানুষ বাংলাদেশে আমি দেখি না। তিনি বাংলাদেশের পাঠাগারগুলো সমৃদ্ধিকরণে যা করছেন, তা আমাদের মনে থাকবে সারা জীবন। আমি চাই তিনি দীর্ঘজীবী হোন।

কুড়িগ্রাম উপজেলার সাতভিটা গ্রন্থনীড়ের প্রতিষ্ঠাতা দিনমজুর জয়নাল আবেদিন বলেন, স্যার আমার পাঠাগারেও দিয়েছেন তিন শতাধিক বই। তিনি বলেন, এমন মানুষ বাংলাদেশে আছে ভাবতে আমার অবাক লাগে। সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের সভাপতি আব্দুস ছাত্তার খান বলেন, নিজ উদ্যোগে দেশের পাঠাগারগুলোতে তিনি বই দিচ্ছেন। পাশাপাশি বুক শেলফ, আলমারি এবং নগদ অর্থ সহায়তা। তিনি যে বইগুলো পাঠান পাঠাগারগুলোতে সবগুলো বইয়েই নামি-দামি প্রকাশনীর এবং কোয়ালিটি সম্পন্ন। তিনি যে পরিমাণ অনুদান এবং বই দেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রও তেমন সহযোগিতা করে না। 

তিনি আরো বলেন, কাজী এমদাদুল হক খোকন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। আট বছর ধরে তিনি যে কাজটি করছেন সেজন্য তার নাম পাঠাগার আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। চাকরিকালীন অবসরে পাওয়া এককালীন টাকা স্ত্রী এবং পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদের লভ্যাংশ থেকে তিনি বছরের পর বছর ধরে নিজেকে ভালো কাজে জড়িয়ে রেখেছেন। 

সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের বিভাগীয় সম্মেলনগুলোতেও তিনি উপস্থিত থাকেন বিশেষ অতিথি হিসেবে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত পাঠাগার সম্মেলনেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন। প্রত্যেকটি বইবিষয়ক আয়োজনে সঙ্গে করে বই নেন তিনি। উপহার হিসেবে দেন সম্মেলনে আসা পাঠাগারগুলোর প্রতিনিধিদের। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে কাজী এমদাদুল হক খোকন বলেন, ‘বাবার দেওয়া উপদেশ অনুযায়ী যাতে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারি এবং আমি যেন মানুষের কল্যাণে এই কাজগুলো করে যেতে পারি সেটাই সবচেয়ে বড় আশা।’ 

 

 

তারেক

সমুদ্রের নিচে পাহাড়

প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ পিএম
সমুদ্রের নিচে পাহাড়
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবী প্রায় ৭০ ভাগ জলরাশিতে আচ্ছাদিত এবং এই বিশাল জলরাশির নিচে লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর ভূতাত্ত্বিক গঠন। যাকে বলা হয়—সমুদ্রের নিচে পাহাড় বা সিমাউন্ট (Seamount)। এগুলো এমন উঁচু ভূমিরূপ যা সমুদ্রতল থেকে উপরে উঠে গেছে, কিন্তু কখনোই জলরাশির ওপরে উঠে আসেনি।

সিমাউন্ট কী: সিমাউন্ট হলো এমন এক ধরনের জলতলভূমি যা সমুদ্রতল থেকে কমপক্ষে ১ হাজার মিটার (৩ হাজার ৩০০ ফুট) উচ্চতায় উঠে গেছে। এগুলো সাধারণত নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি থেকে গঠিত, যা একসময় লাভা উদগীরণ করে সমুদ্রপৃষ্ঠে ওঠে এসেছিল। বিশ্বব্যাপী প্রায় ১ লাখেরও বেশি সিমাউন্ট রয়েছে, যার মধ্যে কিছু কিছু হিমালয়ের থেকেও উঁচু! 

মিড-ওশান রিজ (Mid-Ocean Ridge): এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পর্বতশৃঙ্গ, যা প্রায় ৬৫ হাজার কিলোমিটার (৪০ হাজার মাইল) জুড়ে বিস্তৃত। এটি সমুদ্রের তলদেশে দুটি টেকটোনিক প্লেটের বিচ্ছিন্নতার ফলে সৃষ্টি হয়েছে। এখানে লাভার উদগীরণ ঘটে, যা নতুন সিমাউন্টের জন্ম দেয়। 

সিমাউন্ট চেইন (Seamount Chain)

এগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত সিমাউন্টের একটি শৃঙ্গ, যা সাধারণত একটি প্লেটের গতির কারণে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ একটি সিমাউন্ট চেইনের অংশ। সিমাউন্টগুলো গভীর সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শৈবাল, কোরাল এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী বাস করে। 

গবেষণা ও আবিষ্কার: সাম্প্রতিক সময়ে, সিমাউন্টগুলোর ওপর গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে শ্মিডট ওশান ইনস্টিটিউটের গবেষকরা চিলির উপকূল থেকে ৯০০ মাইল দূরে নাজকা রিজে একটি নতুন সিমাউন্ট আবিষ্কার করেছেন, যা বুর্জ খলিফার থেকেও উঁচু। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সিমাউন্ট নেই, তবে বঙ্গোপসাগরের গভীর এলাকায় কিছু ছোট পাহাড় বা টিলা থাকতে পারে।

 

তারেক

সর্পিল সিঁড়ি: দুর্গ প্রতিরক্ষার এক অভিনব কৌশল

প্রকাশ: ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০০ এএম
সর্পিল সিঁড়ি: দুর্গ প্রতিরক্ষার এক অভিনব কৌশল
ছবি: সংগৃহীত

সর্পিল সিঁড়ির ইতিহাস অনেক পুরোনো। মধ্যযুগের সর্পিল সিঁড়িগুলো (যা সাধারণত ঘড়ির কাঁটার দিকেই ঘোরে) কেবল দুর্গের সৌন্দর্যের জন্য তৈরি হয়নি; বরং এগুলো সামরিক প্রতিরক্ষার জন্যও বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল। দুর্গের টাওয়ার বা প্রাচীর বরাবর নির্মিত এই বৃত্তাকার সিঁড়িগুলো শত্রুদের ওপরের তলায় উঠতে বাধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।

সামরিক কৌশলে এই সিঁড়ির নকশা এক বিশেষ সুবিধা এনে দিত। ভারী অস্ত্রধারী সেনারা সহজে একসঙ্গে ওপরে উঠতে পারত না। সিঁড়ির বাঁক এমনভাবে তৈরি করা হতো যে, আক্রমণকারীর ডান হাত সরু রাস্তার কারণে দেয়ালের সঙ্গে বাধাপ্রাপ্ত হতো, ফলে সে অস্ত্র ভালোভাবে চালাতে পারত না। অন্যদিকে, প্রতিরক্ষাকারী ব্যক্তি ওপরের অবস্থানে থেকে অতর্কিতভাবে অস্ত্র চালাতে পারত, যা তাকে কৌশলগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখত।

আধুনিক স্থাপত্যেও সর্পিল সিঁড়ির কদর রয়েছে। মানুষের মনে এখনো এটি স্থান করে আছে। ধরুন, আপনি কোনো ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে গেলেন আর সেখান যদি সর্পিল সিঁড়ি চোখে পড়ে নিশ্চয় ভালো লাগবে! কিংবা আপনার বাড়ির সিঁড়িটি সোজাসুজি না হয়ে সর্পিল হতো, কেমন হতো! পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা এ সর্পিল সিঁড়ি নিদর্শন বয়ে বেড়াচ্ছে। এগুলো কাঠ, পাথর কিংবা ধাতু দিয়ে তৈরি। প্রতিটির রয়েছে কোনো না কোনো ইতিহাস।

তাই তো ভ্যাটিক্যানের ব্রামান্টে স্টেয়ারকেস, ট্রাজানের কলাম, লরেটো চ্যাপেল ইত্যাদি এখনো মানুষের কাছে বিস্ময়। সর্পিল স্থাপত্যের আরেকটি নিদর্শন রোমের কলোসিয়াম।

সর্পিল সিঁড়ি নান্দনিকতা ও স্থাপত্য শিল্পে অনন্য। শুধু সৌন্দর্যবর্ধন নয়, এটি ঘরের ভেতর আলো ও বায়ু চলাচলও ভালো রাখে। সাপের মতো প্যাঁচানো বিধায় এর মাঝে আলো ও ছায়ার সুন্দর সমন্বয়ও ঘটে। সর্পিল সিঁড়ি আমাদের সামনে পুরোনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। তুলে ধরে মানুষের কৃতিত্ব।

 

 

তারেক

‘আমরা মোটা এবং আমরা এভাবেই ভালো আছি’

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১০ পিএম
আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৫ পিএম
‘আমরা মোটা এবং আমরা এভাবেই ভালো আছি’
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান যুগে ‘বডি পজিটিভিটি’ বা ‘শরীর নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে যত আলোচনা, সমর্থন এবং সামাজিক আন্দোলন চলছে, তা দেখে অনেকেই ভাবেন, বিষয়টি হয়তো আধুনিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেরিয়ে আসবে ভিন্ন কথা।

১৯০৪ সালে আমেরিকায় গড়ে ওঠে এক ব্যতিক্রমী ক্লাব (‘Fat Men’s Club’)। সেই সময়েও কিছু সাহসী মানুষ নিজের গড়ন, শরীর ও উপস্থিতি নিয়ে গর্ব করতেন এবং তারা সমাজকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে মোটা হওয়া মানেই দোষের নয়, অপমান নয় বরং তা হতে পারে গর্ব ও সম্মানের বিষয়। শতাব্দী পুরোনো সেই ক্লাবের ইতিহাসে আজ জানব তাদের উদ্দেশ্য, শর্তাবলি এবং সমাজে রেখে যাওয়া বার্তা।

প্রথমেই জানা যাক ক্লাবের জন্মের প্রেক্ষাপট। ১৯০৪ সাল—বিশ্ব যখন দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিল্পবিপ্লবের রেশ ছড়িয়ে গেছে আমেরিকার সমাজে। তা ছাড়া নগরায়ণ ও আধুনিকতার ছোঁয়া পড়ছে সর্বত্র। এই সময়েই গড়ে ওঠে একটি অভিনব ক্লাব, যার সদস্য হতে হলে প্রয়োজন ছিল একটি বিশেষ ‘যোগ্যতা’। আর সেটা হলো আপনার ওজন হতে হবে কমপক্ষে ২০০ পাউন্ড বা প্রায় ৯০ কেজি। ক্লাবটির সূচনা হয়েছিল আমেরিকার ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যে। পরে এর শাখা ছড়িয়ে পড়ে ম্যাসাচুসেটস, নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি এবং অন্যান্য স্থানে। যদিও ক্লাবটির মূল কার্যক্রম চলেছিল অল্প কিছু বছর, তবে তার প্রভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যতিক্রমিতা আজও ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে এক বিশেষ স্থান। ‘Fat Men's Club’ ছিল ইতিহাসের এক বিরল উদাহরণ যেখানে শরীরকে ভালোবাসা, নিজেকে গ্রহণ করা এবং সামাজিক গড়ন ভেঙে নতুন বার্তা দেওয়ার এক সাহসী প্রয়াস লক্ষ করা যায়। সমাজের চোখে মোটা হওয়া; যেটা ছিল ত্রুটি, সেই মোটা শরীরকেই তারা বানিয়েছিল গর্বের প্রতীক। যদিও ১৯২০ দশকের পরে এই ক্লাবগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন- স্বাস্থ্য সচেতনতার প্রবণতা, মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘স্লিম বডি’র প্রমোট, এবং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সদস্যদের বার্ধক্যজনিত অক্ষমতা। মজার ব্যাপার এই বিশেষ ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্যও রয়েছিল বেশ কিছু শর্ত যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- 

-ওজন কমপক্ষে ২০০ পাউন্ড বা ৯০ কেজি হতে হবে।

-বছরে ১ ডলার (বর্তমানে প্রায় ৩৬ ডলার সমমূল্যের) সদস্য ফি দিতে হবে।

-প্রতিবার ক্লাবের বৈঠকে হাজিরা দেওয়া আবশ্যিক ছিল।

-সদস্যদের সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে একে অপরের সঙ্গে হাত মেলানো। তা ছাড়া হাসিমুখে কুশল বিনিময় করাও ছিল শর্তের মধ্যে। 

এই ক্লাবের উদ্দেশ্য ও দর্শন: এই ক্লাবের মূল দর্শন ছিল একটাই ‘আমরা মোটা এবং আমরা এভাবেই ভালো আছি।’ তাদের মতে সমাজে যে সৌন্দর্যের ধারণা প্রতিষ্ঠিত ছিল যেখানে পাতলা, সুঠাম দেহকেই ‘আকর্ষণীয়’ হিসেবে বিবেচিত করা হতো যা মূলত এক ধরনের শারীরিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। ক্লাবটির উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে এই বার্তা দিতে যে, মোটা হওয়া কোনো ব্যর্থতা নয়, শরীর যেমনই হোক, সমাজে সম্মান পাওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপের দেহ দরকার নেই। যে যেমন সে সেভাবেই সুন্দর। এই বার্তা তখনকার দিনে খুবই সাহসিকতার ব্যাপার ছিল।

ক্লাবের অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রম: প্রতিবার ক্লাবের বৈঠকে একটি বিশাল ভোজের আয়োজন করা হতো। মোটা পুরুষদের জন্য উপযোগী খাবারের তালিকায় থাকত  সুস্বাদু মাংস, চিজ, মিষ্টি ও নানা ধরনের পানীয়। ক্লাবের সদস্যরা একত্রিত হয়ে গল্প করতেন, হাসতেন, সমাজের নানা বিষয়ে মতবিনিময় করতেন একে অপরের সঙ্গে। এসব বৈঠক ছিল এক ধরনের উৎসব যেখানে শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতা নয়, বরং গর্বের সঙ্গে তা উদযাপন করা হতো। ক্লাবের এই বৈঠকগুলো সেই সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রেও প্রচারিত হতো। ফলে সমাজের নানা স্তরের মানুষ বিষয়টি জানতে পারতেন। তাদের বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট- ‘আমরা এমনই এবং আমাদের এই রূপেই মানিয়ে নেওয়া হোক।’

তৎকালীন সমাজে সৌন্দর্যবোধ বেশ একমুখী ছিল। নারীদের ক্ষেত্রে ছিল চিকন শরীর, পুরুষদের ক্ষেত্রে সুগঠিত দেহ। এর ব্যতিক্রম হলে অন্যদের চোখে দৃষ্টিকটু ভাব দেখা যেত। এই ক্লাব সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল। তবে সব প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক ছিল ঠিক তা নয়। অনেকেই এটিকে খারাপভাবে দেখত। আবার কেউ কেউ এটিকে ‘অসুস্থ জীবনযাপনকে উৎসাহ’ হিসেবে দেখে সমালোচনা করত। 

সবশেষে বলা যায় আজকের দিনে যখন ‘body shaming’ বিরোধী আন্দোলন চলছে, সে হিসেবে তখনকার এই ক্লাবকে এক ধরনের অগ্রপথিক বলাই যায়। তারা শত বছর আগেই দেখিয়েছিল আত্মবিশ্বাস এবং পারস্পরিক সমর্থন থাকলে শারীরিক গড়ন কোনো সীমাবদ্ধতা নয়। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেন, আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে ওঠে নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকে। ‘Fat Men’s Club’ সেই ভালোবাসাকেই প্রতিষ্ঠা করেছিল বাস্তবে। এই ক্লাব শুধুই একটি সামাজিক সংগঠন ছিল না বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গির বিপ্লব, এক আত্মমর্যাদার উত্থান এবং এক পরিবর্তনের বার্তা বয়ে এনেছিল।

 

তারেক

মাটির তৈরি বহুতল ভবন!

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৭ পিএম
আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫৫ পিএম
মাটির তৈরি বহুতল ভবন!
ছবি: সংগৃহীত

কথাবার্তা ও আচার-আচরণে যেমন মানুষের পরিচয় পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি মানুষের আভিজাত্য প্রকাশ পায় বাড়ির সৌন্দর্য আর বিলাসিতায়। একটা সময় মাটি, বাঁশ, ছন কিংবা টিন দিয়ে ঘর তৈরি করা হতো। এর পর সে জায়গায় এল ইট-সিমেন্ট।

তবে জানেন কি, পৃথিবীর বুকে এমন একটি শহর রয়েছে যেখানকার সব ঘর, এমনকি বহুতল ভবনও তৈরি করা হয়েছে মাটি দিয়ে। শহরটির নাম শিবাম। এটি ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলের হাদরামাউত উপত্যকায় অবস্থিত। এখানকার সমস্ত বহুতল ভবন তৈরি করা হয়েছে কাঁচা মাটি দিয়ে। 

শিবামকে ‘মরুভূমির ম্যানহাটন’ বা ‘পৃথিবীর প্রথম উঁচু ভবনবিশিষ্ট শহর’ বলা হয়। শিবামের স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণ প্রক্রিয়া, ইতিহাস ও টিকে থাকার রহস্য এক অনন্য বিষয়।
শিবাম শহরের ইতিহাস তৃতীয় শতকের দিকে গড়ে উঠলেও বর্তমান আকার ধারণ করে ১৬ শতকে। এই শহর মূলত হাদরামাউত উপত্যকার বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে ব্যবসায়ীরা একত্রে বসবাস করতেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের সংযোগস্থল হওয়ায় শিবাম ঐতিহাসিকভাবে অনেকবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ফলে স্থানীয়রা আত্মরক্ষার জন্য শহরটিকে উঁচু ও সুরক্ষিত কাঠামোয় গড়ে তোলে।

১৯৮২ সালে শিবামকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ইউনেসকো। কারণ এটি ঐতিহ্যগতভাবে টিকে থাকা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উচ্চ নগরী। শিবাম শুধু একটি শহর নয়, এটি মানবসভ্যতার স্থাপত্যশিল্পের এক বিরল নিদর্শন। আধুনিক প্রযুক্তির আগে কীভাবে মানুষ টিকে থাকার জন্য স্থাপত্যশৈলীকে অভিযোজিত করেছিল, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শিবাম।

প্রায় ৫০০টির বেশি বহুতল দালান রয়েছে শিবামে। বেশির ভাগ ভবন সাধারণত ৫ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত উঁচু। কিছু ভবনের উচ্চতা ৩০ মিটার পর্যন্ত। ভবনগুলো খেজুরগাছের কাঠের ফ্রেম দিয়ে শক্তিশালী করা হয় এবং কয়েক বছর পরপর নতুন কাদা দিয়ে সংস্কার করা হয়। প্রথম তলায় পশুর জন্য গোয়ালঘর বা দোকান থাকে, ওপরের তলাগুলো বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই অঞ্চলের বাড়িগুলো কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি করার বিশেষ কিছু কারণও আছে বটে। প্রথম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। শিবাম এক মরুভূমির শহর, যেখানে বৃষ্টি খুবই কম হয়, কিন্তু যখন হয়, তখন তা হয় প্রবল। তা ছাড়া, এখানে প্রচণ্ড গরম ও ধূলিঝড় লেগেই থাকে। কাঁচা মাটির (আদোব বা সানাই মাটি) দেয়াল গরমে ঘরকে শীতল রাখে এবং শীতকালে উষ্ণতা ধরে রাখে। এ ছাড়া, ভূমিকম্প প্রতিরোধেও মাটির দালান বেশ কার্যকর।

পাথরের জোগান কম থাকায় এবং কাঠের অভাব থাকায় শিবামের অধিবাসীরা সহজলভ্য কাদা, খড় ও খেজুরগাছের কাঠ ব্যবহার করে দালান নির্মাণ করে। এর ফলে খরচ কমে এবং পরিবেশবান্ধব নির্মাণ সম্ভব হয়। শিবামের প্রতিটি দালানই একেকটি দুর্গের মতো। অতীতে দস্যু ও শত্রুদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য শহরের চারপাশ ঘিরে এক ধরনের উঁচু দুর্গশৈলীর নকশায় নির্মাণ করা হয়। সরু গলিপথ এবং সংযুক্ত বাড়িগুলো আক্রমণকারীদের চলাচল কঠিন করে তোলে।

তবে শিবামের ভবনগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকলেও আধুনিক শহরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পর্যাপ্ত সংরক্ষণ না করার ফলে এটি এখন ধ্বংসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষত ২০০৮ ও ২০১৫ সালের বন্যায় অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুসলিম অধ্যুষিত প্রাচীন এই শহরটি আজও তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। বর্তমানে প্রায় সাত হাজার মানুষ এই শহরটিতে বসবাস করে।

 

তারেক

অ্যান্টার্কটিকার অজানা গল্প

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৪ এএম
আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৫৯ এএম
অ্যান্টার্কটিকার অজানা গল্প
ছবি: সংগৃহীত

অ্যান্টার্কটিকা—পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ। আয়তনে ১ কোটি ৪২ লাখ বর্গ কিলোমিটার। অথচ এখানকার বেশির ভাগ জায়গায় মানুষের পা পড়েনি। এই মহাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল, শুষ্ক এবং বায়ুহীন অঞ্চল। দিগন্তজোড়া বরফ আর রহস্যে ঘেরা এই সাদা রাজ্য সম্পর্কে রয়েছে অসংখ্য চমকপ্রদ তথ্য।

বরফের সুরক্ষা চুক্তি

১৯৫৯ সালের ১ ডিসেম্বর, অ্যান্টার্কটিকার সুরক্ষার জন্য স্বাক্ষরিত হয় ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’। এতে বলা হয়, এই মহাদেশ কোনো দেশের মালিকানাভুক্ত হবে না, এখানো সামরিক কোনো কার্যক্রম চালানো যাবে না, খনিজ আহরণ নিষিদ্ধ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। 

বরফে বন্দি মিঠা পানি

পৃথিবীর প্রায় ৭০% মিঠা পানি অ্যান্টার্কটিকার বরফে আটকে আছে। যদি এই বরফ একবার গলে যায়, তা হলে পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠ প্রায় ২০০ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যাবে। তাই বলা হয়ে থাকে, এই বরফ একদিকে যেমন বিপদ, তেমনি বিশাল এক সম্ভাবনার উৎস।

একমাত্র সরীসৃপহীন মহাদেশ

অ্যান্টার্কটিকাই হলো পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ, যেখানে কোনো সরীসৃপ জাতীয় নেই। এখানকার ঠাণ্ডা পরিবেশে বাহ্যিক তাপের ওপর নির্ভরশীল সাপ, কেঁচো কিংবা টিকটিকি বাঁচতে পারে না। কারণ মাটি সর্বদা হিমায়িত থাকে, যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত নয়।

ফেলে দিতে হবে আক্কেল দাঁত!

অ্যান্টার্কটিকায় যদি কেউ দীর্ঘ সময় কাজ করতে যান, তা হলে অবশ্যই আগেভাগে অ্যাপেনডিক্স ও আক্কেল দাঁত বাদ দিতে হয়। কেননা সেখানে সার্জারি করার মতো ব্যবস্থা নেই। ডাক্তার থাকলেও তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সার্জন নন। ভবিষ্যতে বিপদ এড়াতে এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

অ্যান্টার্কটিকার নিজস্ব ডোমেইন!

যদিও অ্যান্টার্কটিকায় কোনো স্থায়ী মানববসতি বা দেশ নেই, তবুও এর রয়েছে একটি নিজস্ব ওয়েব ডোমেইন: .AQ। যেমন- বাংলাদেশের ডোমেইন .BD, তেমনি গবেষণা ও সংস্থাভিত্তিক কার্যক্রমে এই ডোমেইন ব্যবহার করা হয় অ্যান্টার্কটিকার ক্ষেত্রে।

 

তারেক