
কমলাঘাট নদীবন্দরে একসময় হাঁকডাক আর কোলাহল লেগেই থাকত। এ বন্দর থেকে সরাসরি স্টিমারে কলকাতায় আসা-যাওয়া করা যেত। তখনকার সময়ে কলকাতা থেকে প্রচুর কমলা এ ঘাটে আসত। তা থেকেই কমলাঘাট নামের উৎপত্তি। এ নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে এ খালের মোহনায় বিশাল বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাস শুরু হয়।
এ অঞ্চলের বেদেদের জীবন-জীবিকা মূলত নারীকেন্দ্রিক। তাদের বিয়ের সময়ই পুরুষদের কামাই-রুজি করে খাওয়ানোর ওয়াদা করতে হয়। তারপরও বেদে সম্প্রদায়ের অনেক পুরুষ একাধিক বিবাহ করে থাকেন। তাই নারীকে সব সময়ই রুটি-রুজির জন্য লড়াই করে যেতে হয়। পুরুষরা এ সময় নৌকায় অলস সময় কাটিয়ে থাকে। কেউ কেউ নৌকায় করে আবার মাছও ধরে থাকে। কমলাঘাট বন্দর ছাড়াও বিক্রমপুর এলাকা জুড়ে আরও অনেক যাযাবর বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। বিশেষ করে লৌহজং এলাকায় বিশাল বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা বিভিন্ন সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়ে কেউ গাওয়াল করছেন। আবার কেউ সাপের খেলা দেখান, শিঙা লাগান। কেউ তাবিজ-কবজও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
এখন তপ্ত দুপুর। কমলাঘাট বন্দরে রূপসী জোছনা বেদেনির গগনবিদারী চিৎকারে চারদিকে মানুষজন জড়ো হয়েছে। অভাব আর পেটের ক্ষুধায় তার জীবন থেকে ফুটফুটে বাচ্চাটি অকালে ঝরে পড়েছে। চিৎকার করে কাঁদছে বেদেনি। যে চিৎকার আল্লাহর আরশে গিয়ে মনে হয় পৌঁছাবে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। নদীর খাল পাড়ে লোকে লোকারণ্য। খাল পাড়ের শত শত লোক এসে ভিড় করছে বেদে নৌকার কাছে এসে। কারও মুখে কোনো ভাষা নেই। সবারই চোখে নীরব অশ্রুপাত ঘটে চলেছে। তার কারণ, সান্ত্বনা দেওয়ার যে কোনো ভাষা নেই। এমন মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী এ খাল পাড়ের মানুষ শতবছরেও দেখেনি।
বেদেনি জোছনার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে অনেক আগেই। স্বামীর সংসারে খুব ভালোই চলছিল জোছনার জীবন। জোছনা দেখতে-শুনতে চোখে পড়ার মতো। একহারা গড়ন। কাজল কালো চোখ, ভরাট বক্ষদ্বয়। জোছনা তাদের বেদে সম্প্রদায়ের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে স্থানীয় একটি ছেলের প্রেমে পড়ে। কিন্তু লোকালয়ের ছেলের অভিভাবক তাদের গোপন বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। জোছনার পেটে একটি বাচ্চা রেখেই তাকে ছেড়ে চলে যায় তার স্বামী। মায়ের গর্ভে বাচ্চাটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তা নিয়েই জোছনাকে কাজ করতে যেতে হয়। পেটের ক্ষুধা না বোঝে প্রেম, না ভালোবাসা। ৯ মাস পূর্ণ হলে জোছনার কোল জুড়ে ফুটফুটে একটি ছেলে আসে। শত অভাব থাকলেও ছেলেকে চোখের আড়াল করেনি জোছনা বেদেনি। পিঠে পরনের কাপড়ের সঙ্গে ঝুলিয়েই সাপের খেলা, তাবিজ-কবজ বিক্রি করতে যেত। সেই রোজগারেই চলছিল জোছনার দিনকাল।
ছেলেটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। কিন্তু জোছনা বেদেনির সে নজরকাড়া রূপের ঝলক এখন আর নেই। রোদে তাপে কাজল কালো মাটির রূপ ধারণ করেছে এখন সে। চোখের নিচে জমেছে কালো কালি। শরীরও অনেকটা রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষ এখন আর সাপের খেলা দেখে সেভাবে চাল-ডাল দেয় না। সেরকম তাবিজ কবজেও এখন আর মানুষের বিশ্বাস নেই। কয়েক গ্রাম ঘুরতে পারলে হয়তো চলার মতো কিছু খাবারের পয়সা জোটে। মানুষ কীভাবে তার সাপের খেলা দেখে পয়সা দেবে? এখন তাদেরই কিনে খেতে হয়। নীরব অভাব চারদিক দিয়ে ধেয়ে আসছে মানুষের জীবনে। গ্রামের মানুষের মনে এখন আর সেই আগের মতো আনন্দ-ফুর্তি নেই। একটা নীরব দুর্ভিক্ষ যেন বয়ে যাচ্ছে। আগে ছেলেটিকে কোলে করে কখনো বা পিঠে বেঁধে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারত। এখন আর জোছনার শরীরে সেরকম বল-শক্তি নেই। বয়স বেশি না হলেও অভাব তাকে কাবু করে ফেলেছে। নিজে না খেলেও দুধের ছেলেটিকে দুধ কিনে খাওয়াতে হয়।
তখন বর্ষাকাল ছিল। চারদিকে পানিতে থই থই করছে। নৌকা একটি বাঁশের লগির সঙ্গে বাঁধা। আজ আর শরীরে কুলাচ্ছে না। কয়েকদিন ধরে জ্বরের প্রকোপের কারণে নৌকা থেকে আর নামতে পারেনি। এদিকে ছেলের জন্য দুধ কেনার টাকাও ফুরিয়ে গেছে। জোছনার স্বামী সেই যে ছেড়ে গেছে আর একবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি। বাচ্চা বড় হচ্ছে। তাকে লালন পালন করতে একাই লড়ে যাচ্ছে জোছনা। সামনে কোরবানির ঈদ। তাই জ্বর শরীর নিয়েই বের হতে হচ্ছে জোছনাকে। কিন্তু এ জ্বরের শরীরে বাচ্চা নিয়ে রোদের মধ্যে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতে পারবে না সে। তাই অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করল বাচ্চাটিকে নৌকার ভেতর শিকলে বেঁধে রেখে যাবে। ছেলে একটু একটু হাপুড় দিয়ে এদিক সেদিক যেতে পারে। এটাই জোছনার কাছে সবচেয়ে ভয়ের কারণ। কিন্তু আর কোনো উপায়ও নেই তার কাছে। একটি শিকল কিনে ছেলেটি নৌকার ভেতর বেঁধে রেখে জোছনা বেদেনি গ্রাম ঘুরতে চলে যায়।
আজ কেন যেন জোছনার পা এগোতে চায় না। হাঁটতে গেলে অবশ অবশ লাগে। তারপরও পেটের ক্ষুধার কাছে তাকে হার মানতে হলো। বাচ্চাটিকে একাই নৌকার ভেতর শিকলে বেঁধে তাকে মাটিতে নামতে হলো। কে জানত তার এমন ভয়াবহ সর্বনাশ ঘটে যাবে। আজ সে বেশি দূর যায়নি। আশপাশের দু-এক গ্রাম ঘুরেই জোছনা চলে এসেছে।
নৌকায় উঠেই জোছনা বেদেনি আর্তচিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ল। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে গগনবিদারী চিৎকার যেন সাত আসমানে পৌঁছাচ্ছে। বাচ্চাটি শিকলে বাঁধা থাকলেও শিকল ছিল একটু বড়। তাতেই বাচ্চাটি পানিতে পড়ে মারা যায়। শিকলে বাঁধা ছিল বলে নৌকার সঙ্গেই মরে ভাসতে থাকে। জোছনা বেদেনিকে ছেলেটির জন্য আর গ্রাম করতে যেতে হবে না। একটি অভাব জোছনা বেদেনির ভেতরটা সারা জীবন কুরে কুরে খাবে। সাত রাজার ধন হারিয়ে জোছনা এখন নির্বাক। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নৌকার আশপাশে শত শত লোক। সবার চোখেই পানি গড়িয়ে পড়ছে। কারও মুখে কোনো ভাষা নেই। নীরর অশ্রু ঝরছে সবার চোখ থেকে। এভাবেই নীরব অশ্রুপাতে সমাপ্ত ঘটল একটি অপরিণত ভবিষ্যতের।
মিরাপাড়া, রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ
তারেক