স্বাদ, গন্ধ এবং পুষ্টিগুণের জন্য আমকে বলা হয় ফলের রাজা। দেশে হিমসাগর, ল্যাংড়া, আম্রপালি, গোপালভোগ, ফজলিসহ বিভিন্ন জাতের আম দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বিশেষ করে আম্রপালি আম রঙে, গন্ধে, স্বাদে একেবারে অনন্য।
বিজ্ঞান ও প্রকৃতির মিলনে জন্ম নেওয়া আম্রপালি আমের গল্পটি একটু ব্যতিক্রম, একটু রোমাঞ্চকর। যার ইতিহাস অনেক আমপ্রেমীরই অজানা।
চলুন জেনে নেওয়া যাক আঁশহীন, সুমিষ্ট ও রসালো এই আমের নামকরণের পেছনের রোমাঞ্চকর ইতিহাসটি-
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। প্রাচীন ভারতে বৈশালী নামে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের এক আমবাগানে এক ব্যক্তি একটি বাচ্চাকে আমগাছের নিচে খুঁজে পান। যেহেতু তাকে আমগাছের নিচে পাওয়া যায়, তাই তার নাম রাখা হয় আম্রপালি। আম্রপালি মেয়েটি কেবল রূপে নয়, গুণেও ছিলেন অনন্য। তিনি গান গাইতেন, নাচতেন, বীণা বাজাতেন এবং কবিতা লিখতেন। এক সময় হয়ে ওঠেন বৈশালীর সেরা নর্তকী। তার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয় দেশ-বিদেশের রাজা-রাজপুত্র ও সাধারণ মানুষ। শুরু হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত। কারণ সবাই তাকে দেখতে ও বিয়ে করতে চায়।
এ অবস্থায় তার পালক মা-বাবা চিন্তিত হয়ে বৈশালীর গণ্যমান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তখন বৈশালীর সকল ক্ষমতাবান ও ধনবান ব্যক্তি মিলে বৈঠকে বসে নানা আলোচনার পর যে সিদ্ধান্ত নেন তা হলো, আম্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। সে হবে একজন নগরবধূ। মানে সোজা বাংলায় পতিতা। ইতিহাসে এভাবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে কাউকে পতিতা বানানো হয়েছে এমন সিদ্ধান্ত খুবই বিরল। আম্রপালি সে সভায় ৫টি শর্ত রাখেন। শর্তগুলো হলো-
-নগরের সবচেয়ে সুন্দর ঘরটি হবে তার।
-প্রতি রাতের জন্য মূল্য পাঁচ শত স্বর্ণমুদ্রা।
-একবারে মাত্র একজন তার গৃহে প্রবেশ করতে পারবে।
-শত্রু বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার তার গৃহে প্রবেশ করা যাবে।
-কে এলেন আর কে গেলেন এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান করা যাবে না।
সবাই তার এসব শর্ত মেনে নেন।
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজা ছিলেন বিম্বিসার। নর্তকীদের নাচের অনুষ্ঠানে তিনি এক নর্তকীর নাচ দেখে বলেছিলেন, এ নর্তকী বিশ্বসেরা। তখন তার একজন সভাসদ বলেন, মহারাজ এ নর্তকী আম্রপালির নখের যোগ্য নয়। তিনি তার সেই সভাসদের থেকে আম্রপালি সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তাকে কাছে পাওয়ার বাসনা করেন। কিন্তু তার সভাসদ বলেন, তা হলে আমাদের যুদ্ধ করে বৈশালী রাজ্য জয় করতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যে গিয়ে আম্রপালিকে দেখে আসবেন।
দেখা করতে গিয়ে রাজা চমকে ওঠেন- এ তো কোনো নারী নয়, যেন সাক্ষাৎ পরী! কিন্তু আম্রপালি প্রথম দেখাতেই তাকে মগধ রাজ্যের রাজা বলে চিনে ফেলেন এবং জানান তিনি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন বহু আগে থেকেই। কিন্তু আম্রপালি জানান, তার রাজ্যের মানুষ কখনোই এটা মেনে নেবেন না। ওদিকে আম্রপালি তার নিজের রাজ্যর কোনো ক্ষতি চান না। তাই তিনি রাজাকে তার নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠান।

এদিকে বিম্বিসারের সন্তান অজাতশত্রুও আম্রপালির প্রেমে মগ্ন ছিলেন। তিনি আম্রপালিকে পাওয়ার জন্য বৈশালী রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। কিন্তু দখল করতে সক্ষম হননি এবং খুব বাজেভাবে আহত হন। এত নাটকীয়তার পর শেষের দিকে এসে কী হলো?
অন্যদিকে গৌতম বুদ্ধ তার কয়েক শ সঙ্গী নিয়ে একদিন বৈশালী রাজ্যে এলেন। সেখানের এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে আম্রপালির মনে ধরে গেল। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে চার মাস তার কাছে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন। সবাই ভাবলেন বুদ্ধ কখনোই রাজি হবেন না। গৌতম বুদ্ধ তাকে রাখতে রাজি হলেন এবং এটাও বললেন, সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত! চার মাস শেষ হলে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আম্রপালির রূপের কাছে শ্রমণ হেরে গেলেন কি না তা জানার জন্য? কিন্তু না, সেদিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন। আম্রপালি তখন বুদ্ধকে বলেন, এই প্রথম কোনো পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালী নগরবধূ আম্রপালি।
পরে সবকিছু দান করে বাকি জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন ইতিহাস বিখ্যাত সেই রমণী আম্রপালি।
প্রশ্ন হচ্ছে, আম্রপালি আমের নাম কীভাবে হলো? উত্তর ভারতের দশেরি জাতের পুরুষ পরাগ এবং দক্ষিণ ভারতের নীলম জাতের স্ত্রী পরাগের সংকরায়ণের মাধ্যমে ভারতের গবেষকরা একটি নতুন আমের জাত উদ্ভাবন করেন। এই আম স্বাদে, গন্ধে এবং গঠনে ছিল ব্যতিক্রমী। আর তাই এই বিশেষ জাতের নাম রাখা হয় ইতিহাসখ্যাত নগরবধূ ‘আম্রপালি’র নামে।
প্রথমবারের মতো এই জাতের চারা রোপণ করা হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার চাকদহে। এ জাতটি বাংলাদেশে আসে ১৯৮৪ সালে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ এনামুল হক এবং চুয়াডাঙ্গার আজাদ হাইব্রিড নার্সারির কর্ণধার আবুল কালাম আজাদের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে এই জাতটি আমদানি করা হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এই জাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করে এবং নাম দেয় ‘বারি আম-৩’। বর্তমানে কেউ কেউ এই আমকে ‘আম রুপালি’ নামেও ডাকেন।
আম্রপালি আমের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই আম দেখতে ছোট থেকে মাঝারি আকারের, নিচের দিকে সুঁচালো এবং উপরের দিকে গোলাকার। পাকা আমের রং হয় হলুদাভ সবুজ, কখনো লালচে কমলা। খোসা কিছুটা মসৃণ ও তেলতেলে।
এই আমের মিষ্টতার মাত্রা ল্যাংড়া বা হিমসাগরের চেয়েও বেশি। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় বিটা ক্যারোটিন, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আম্রপালি গাছে গুচ্ছ ধরে অনেকগুলো আম একসঙ্গে হয়। তবে গাছটির আয়ু তুলনামূলকভাবে কম। পাকা আম্রপালি সাধারণত জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে আসে এবং বেশ কয়েকদিন ঘরে সংরক্ষণ করা যায়।
তারেক