কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যার পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন কৃষকরা। তারা আবারও চাষাবাদে ফিরছেন। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর তারা আমন ধানের মৌসুম কাজে লাগাতে বীজতলা তৈরি ও বেশি দামে চারা সংগ্রহ করছেন। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, সরকার বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করছে এবং নদী ভাঙনের পলিমাটি ফসলের ফলন উন্নত করতে সহায়তা করবে। এবারের বন্যায় কৃষিখাতে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এখনো কুমিল্লার বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলার ৬৪ হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে রয়েছে।
গত ২০ আগস্ট থেকেই কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হতে থাকে। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, বন্যার ভয়াবহতাও তত বেড়েছে। ২২ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় কুমিল্লার কোল ঘেঁষে বয়ে চলা গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর একে একে জেলার ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪ উপজেলা প্লাবিত হয়ে যায়। এর ফলে তলিয়ে যায় কৃষকের ফসলি জমি এবং জমির ফসল। বন্যাকবলিত কুমিল্লার ১৪ উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলার ফসল প্রায় পুরোপুরি ডুবে গেছে। বাকি ৭ উপজেলায় ফসলের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এখনো পুরোপুরি জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে মনোহরগঞ্জ উপজেলার ফসলের মাঠ। এ ছাড়া অন্যান্য আরও কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ জমিও পানির নিচে ডুবে আছে।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে রোপা আমন বীজতলা ৪ হাজার ৫১৫ হেক্টর, ধান ২৩ হাজার ৩০৯ হেক্টর, শাকসবজি ২ হাজার ১৯ হেক্টর, রোপা আউশ ৩৩ হাজার ৫৮০ হেক্টর, আমন ৩৩৫ হেক্টর এবং ২১৬ হেক্টর আখ খেত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে ২০ হাজার ৬৪১ হেক্টর রোপা আমন, ১ হাজার ৬১৫ হেক্টর শাকসবজি, ২০ হাজার হেক্টর রোপা আউশ এবং ১১ হেক্টর আখ ফসলের জমি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। অপরদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০৪ হেক্টর শাকসবজি, ১৩ হাজার ৪৩২ হেক্টর রোপা আউশ এবং ২০৫ হেক্টর আখ ফসলের জমি। সব মিলিয়ে প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে কুমিল্লার কৃষি। আউশের পাকা ধান আর রোপা আমনের বীজতলা ও চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোথাও পলিমাটির তলায় চাপা পড়েছে পাকা ধান, আবার কোথাও দীর্ঘদিন পানিবন্দি থেকে জমিতেই পচে গেছে ফসল। বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে শাকসবজির খেত। মাচায় মাচায় ঝুলছে মৃত সবজির গাছ। এখনো কোথাও কোথাও বানের পানি জমে থাকায় জমিতে চাষাবাদ শুরু করা যাচ্ছে না। একদিকে ঘরবাড়ি, অন্যদিকে জমির ফসল হারিয়ে নিঃস্ব অনেক কৃষক। তবুও অনেকেই আবার আশায় বুক বেঁধেছেন- পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জমি তৈরি করে চারা রোপণ শুরু করেছেন।
বন্যার কারণে বীজতলা বিনষ্ট, চারার সংকট এবং বেশি দামে চারা সংগ্রহ করতে হলেও মৌসুম ধরতে মাঠে নেমেছেন কৃষকরা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রত্যাশা, সঠিকভাবে সরকারি সহযোগিতা পেলে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘গত ২৩ আগস্ট ধান কাটার কথা ছিল। আগের দিন ২২ আগস্ট রাতেই সব শেষ। গোমতী নদীর ভাঙনের ফলে পুকুরের মাছও শেষ, জমির ধানও নেই। ঘরবাড়ি, ধান, মাছ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছি। এ ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠব কিছুই মাথায় আসছে না।’
জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজার এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জমিতে পানি জমে সব চারা নষ্ট হয়ে গেছে। পানি কমে আসায় আবার নতুন করে চারা রোপণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। জমির পাশেই চারা এনে মজুত রেখেছি। যদিও দ্বিগুণ দামে অনেক দূর থেকে চারা আনতে হয়েছে, তাও মৌসুমটা ধরার চেষ্টা করছি।
এদিকে বন্যার দুর্দশার মধ্যেও প্লাবনের পলিমাটি আশীর্বাদ হতে পারে কৃষকের, এমনটি জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ। তবে সে ক্ষেত্রে মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে বীজ ও সার দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আইয়ুব মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বন্যায় কুমিল্লায় কৃষি খেতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আউশ ধান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপা আমন ও রোপা আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন রোপা আমনের মৌসুম পেতে হলে দ্রুত চারা তৈরি করে চারা রোপণ করতে হবে। আমরা সরকারিভাবে বীজ সংগ্রহ ও বিতরণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। কুমিল্লা সেনানিবাসে বীজতলা তৈরি করে আমনের চারা তৈরি করা হচ্ছে। ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এসব চারা দ্রুত কৃষককে সরবরাহ করতে পারব। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে সারও দেওয়া হবে।’
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যালয় কুমিল্লার প্রধান জানান, কৃষিখাতে মোট ক্ষতি ও পুনর্বাসনেও সচেষ্ট রয়েছে সরকার। কৃষি বিভাগ তাদের কাজ শুরু করেছে। আশা করছি কৃষকরা খুব দ্রুত মাঠে ফিরতে পারবেন।