
নড়াইলে দিন দিন চুইঝালের আবাদ বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণে এই জেলার মাটি চুইঝাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। অন্যান্য ফসলের তুলনায় পরিশ্রম একেবারেই কম, রোগবালাইও নেই বললেই চলে। চাষাবাদের জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না; বাড়ির আঙিনা কিংবা বাগানের যেকোনো গাছের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে সহজেই চাষ করা সম্ভব। স্বল্প ব্যয়ে অধিক লাভবান হওয়া যায়। চাহিদা থাকায় বিক্রিতেও ঝামেলা পোহাতে হয় না। এ কারণে দিন দিন মসলা জাতীয় চুইঝাল চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
চাষিরা জানান, বেলে-দোআঁশ মাটিতে চুইঝালের চারা রোপণ করলে সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া যায়। একটি গাছ থেকে কাটিং পদ্ধতিতে নতুন করে চারা উৎপাদন করা যায়, ফলে বারবার চারা কেনার প্রয়োজন হয় না। গাছ রোপণের পর জৈব সার ও পর্যাপ্ত পানি দিলেই হয়; বাড়তি তেমন কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। দুই বছর পর থেকে গাছ বিক্রি করা যায়। গাছের ওজন অনুযায়ী এর দাম নির্ধারণ করা হয়। এর দাম ২ থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। গাছের বয়স যত বাড়ে, দামও বাড়তে থাকে। ১০ বছর রাখলে একেকটি গাছ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়।
নড়াইল পৌরসভার উজিরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সাড়ে তিন একর জায়গায় চুইঝালের চাষ করছেন নাজমুল মোল্যা ও স্বর্ণা ইয়াসমিন দম্পতি। তাদের বাগানে থাকা আম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, সুপারিসহ প্রতিটি গাছের সঙ্গে রয়েছে এক থেকে একাধিক চুই গাছ।
স্বর্ণা ইয়াসমিন বলেন, ‘২০২১ সালে চার থেকে পাঁচটা গাছ লাগিয়ে ছিলাম। ওই গাছ থেকে ডগা কেটে পুনরায় লাগাতে থাকি। এভাবে বাড়তে বাড়তে বাগানে এখন প্রায় ৩ হাজারের মতো চুইঝাল গাছ রয়েছে। ইতোমধ্যে বিক্রি শুরু করেছি। খরচের তুলনায় এর দাম অনেক বেশি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু চুইঝাল চাষে তেমন কোনো খরচ নেই, আলাদা জমিরও প্রয়োজন নেই, তাই এটা থেকে বেশি লাভ করা সম্ভব। আমাদের বাগানে আরও গাছ রয়েছে; আগামীতে সব গাছে চুইঝাল গাছ লাগাব।’
ফয়সাল আমিন নামে এক চুইঝাল চাষি বলেন, ‘প্রায় ১৫ বছর ধরে চুইঝাল চাষ করছি। এতে অতিরিক্ত কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। পরিত্যক্ত জায়গায় এটি চাষ করা সম্ভব। খুবই লাভজনক একটি ফসল। বিক্রিতেও কোনো ঝামেলা নেই, ব্যাপারীরা বাড়িতে এসে কিনে নিয়ে যান।’
চম্পা খাতুন নামে এক নারী বলেন, ‘আমি ২০০৫ সালে ১০টা গাছ দিয়ে চুইঝাল চাষ শুরু করি। সেখান থেকে দেড় লাখ টাকার চুইঝাল বিক্রি করেছিলাম। আমাদের এলাকায় তখন অন্য কেউ করত না, এখন আশেপাশের সবাই চাষ করে।’
আগে চুইঝালের চারা নড়াইলের নার্সারিতে উৎপাদন হতো না। নার্সারি মালিকরা খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া থেকে চারা পাইকারি কিনে এনে বিক্রি করতেন। তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ায় গত দুই বছর ধরে নড়াইলে চারা উৎপাদন হচ্ছে। শহরের ভাদুলিডাঙ্গা এলাকায় আল্লাহর দান নার্সারি অ্যান্ড পলিনেট হাউসে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অন্যান্য গাছের চারার সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে চুইঝালের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।
নার্সারির মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দিন দিন নড়াইলের চুইঝালের চারার চাহিদা বাড়ছে। এক বছর আগে যে পরিমাণ চারা বিক্রি করতাম, এখন তার চারগুণ বেশি বিক্রি হচ্ছে। যা উৎপাদন করছি তা দিয়ে চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে চুইঝাল চাষে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার পরেই নড়াইলের অবস্থান। জেলার তিনটি উপজেলায় বর্তমানে ৭ হাজার ৪৩৭টি পরিবার চুইঝাল চাষে সম্পৃক্ত রয়েছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় মোট ১২ হেক্টর জমিতে চুইঝালের আবাদ হয়েছে, সেখান থেকে ৩০ টন চুইঝাল উৎপাদন হয়। এর আগের অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৫ টন। এক বছরে আবাদ বেড়েছে ৫ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল মাত্র ৯ টন। অর্থাৎ ছয় বছরে উৎপাদন বেড়েছে ২১ টন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আশেক পারভেজ বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলে চুইঝালের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। বাজারে এর চাহিদা অনেক। এ অঞ্চলের যে কয়টি জেলায় চুইঝালের চাষ হয়, তার মধ্যে নড়াইল অন্যতম। স্বল্প খরচ ও অল্প পরিশ্রমে অধিক লাভবান হওয়ায় কৃষক এটি চাষে আগ্রহী হচ্ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকের চুইঝাল চাষ আরও বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি।’