দিনাজপুর শহরের খুব কাছেই গর্বেশ্বরী নদীর তীরে গাবুরা টমেটো বাজার জমে উঠেছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর মৌসুম চলছে। প্রতিদিন ফজরের পর থেকেই আশপাশের উপজেলা থেকে কৃষকরা টমেটো নিয়ে এই বাজারে আসছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর, বীরগঞ্জ, বিরলসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে ভ্যান, ব্যাটারিচালিত রিকশা, বাইসাইকেল ও ট্রাক্টরে টমেটোর ক্যারেট আসে এই বাজারে। বাজারে ভ্যান কিংবা রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে টমেটো বেচাকেনা চলছে। পাইকাররা বাজারদর অনুযায়ী টমেটো কিনছেন।
ভোর হতেই সব টমেটো বিক্রি হয়ে যায়। এর পর পাইকাররা নির্ধারিত ঘরে টমেটো নিয়ে যান। সেখানে বাছাই করে ক্যারেট ভর্তি করা হয়। একেকটি ক্যারেটে ২৪ থেকে ২৫ কেজি টমেটো রাখা যায়। ১০টার পর থেকে এসব ক্যারেট ট্রাকে তুলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। টসটসে পাকা টমেটো দূর-দূরান্তে যাচ্ছে।
এই বাজারে স্থানীয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। তারা টমেটো বাছাই ও ক্যারেট ভর্তি করে পড়াশোনার খরচ জোগাচ্ছেন। বাজারজুড়ে শত শত টমেটো পাইকার রয়েছেন। বাজারের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘরে টমেটো রাখা হয়। সেখান থেকেই প্রতিদিন ক্যারেটে ভরে ট্রাকে লোড দেওয়া হয়।
এই বাজারে এখন আশপাশের কোনো পুরুষ মানুষ বেকার নেই। সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় করছেন।
হাট ইজারাদারদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই বাজারটি জুন মাস পর্যন্ত চলবে। গাবুরা টমেটো বাজারের ইজারাদার আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এই বাজারে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার টমেটো বেচাকেনা হয়।’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে বাজারের আশপাশের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মণ টমেটো বিক্রি হচ্ছে। চাষিরা ভোর থেকেই টমেটো নিয়ে বাজারে আসেন। বাজারদর অনুযায়ী টমেটো বিক্রি করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাইরের পাইকারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাটে ২০ থেকে ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। তারা সার্বিক তদারকি করছেন।’
হাট ইজারা বাবদ প্রতি মণ টমেটোর জন্য ১৫ টাকা নেওয়া হয়। এর বাইরে কোনো অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না। এ কারণে হাটের পরিসর দিন দিন বাড়ছে। বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী আহসান হাবীব বলেন, ‘প্রতিবছর এই বাজারে আসি। পহেলা বৈশাখ থেকে প্রতিদিন চার-পাঁচটি ট্রাক টমেটো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বছর ট্রাক ভাড়া বেশি। তাই লাভ কম হচ্ছে। তবে এখানে প্রচুর টমেটো পাওয়া যাচ্ছে।’
এই বাজারে এখন প্রায় ৮০ থেকে ৯০ জন ব্যবসায়ী অবস্থান করছেন। প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ ট্রাক টমেটো দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে।
ঢাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে তিন মাস ধরে আছি।’ প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ ট্রাক টমেটো কিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘টমেটো বাছাই ও ক্যারেট ভর্তির কাজে এখন ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।’
হোসেনপুরের চাষি ইমতিয়াজ বলেন, ‘এ বছর টমেটোর ফলন ভালো হয়েছে।’ বাজার কাছে হওয়ায় প্রতিদিনই টমেটো বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘এই গ্রীষ্মকালীন টমেটো অনেক লাভজনক। অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।’ চাষি মনসুর রহমান বলেন, ‘দুই বিঘা জমিতে টমেটোর আবাদ করেছি। ১০ দিন ধরে বিক্রি করছি। প্রতিদিন ২৫ মণ টমেটো বিক্রি করছি।’ তিনি বলেন, ‘এই টমেটো চাষ থেকে লাভবান হয়েছি। জমিও কিনেছি। বাজার কাছে হওয়ায় আমরা আরও উৎসাহিত হচ্ছি।’
চিরিরবন্দরের মাসুদ রানা বলেন, ‘রাস্তা ভালো হওয়ায় ১০ বিঘা জমিতে টমেটোর আবাদ করেছি।’ প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। আশা করছেন, প্রতি বিঘায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মণ টমেটো হবে। তিনি বলেন, ‘৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ ধরে বিক্রি করছি। সব মিলিয়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা আছে।’
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক জাফর ইকবাল বলেন, ‘দিনাজপুর ও আশপাশের উপজেলাগুলোতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো ভালো হয়।’ তিনি বলেন, ‘এ বছর ১ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে টমেটোর আবাদ হয়েছে। কৃষি বিভাগ চাষিদের নানা পরামর্শ দিচ্ছে।’