
মুন্সীগঞ্জে আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলার ছয়টি উপজেলায় বিস্তীর্ণ জমিতে কৃষকরা আলু তুলছেন। তবে উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারে দাম কম থাকায় তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। এর মধ্যেই এসেছে স্বস্তির খবর—কম সার ব্যবহার করেও আলুর কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। প্রতি মৌসুমে অন্তত ২৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণে এই তথ্য ওঠে এসেছে।
কম সারে সাশ্রয়
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে ৩৪ হাজার ৭৫৮ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ লাখ টন। পরীক্ষামূলকভাবে ৩০০ কৃষকের জমির মাটি পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ১৫০ কৃষকের জমিতে তৈরি করা হয় প্রদর্শনী প্লট। এতে শতাংশপ্রতি মাত্র তিন থেকে ছয় কেজি সার ব্যবহার করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাঁচ কেজি করে সার প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে, জেলার অন্য কৃষকরা সাধারণত শতাংশপ্রতি ১২ থেকে ১৫ কেজি সার ব্যবহার করেন।
ফলনে তেমন পার্থক্য নেই
পরীক্ষামূলক ফলাফলে দেখা গেছে, কম সার ব্যবহারে আলুর উৎপাদন প্রায় একই রকম হয়েছে। বরং কিছু ক্ষেত্রে কম সার ব্যবহার করা জমিতে ভালো মানের আলু পাওয়া গেছে।
সদর উপজেলার সুখবাসরপুর গ্রামের কৃষক মো. ইব্রাহিম ৮০ শতাংশ জমিতে আলু আবাদ করেছেন। এর মধ্যে ৫ শতাংশ জমিতে প্রদর্শনী প্লট তৈরি করা হয়। তিনি জানান, ‘কম সার ব্যবহৃত জমিতে শতাংশপ্রতি সাড়ে তিন মণ আলু পেয়েছি। অন্যদিকে, বেশি সার ব্যবহৃত জমিতে পেয়েছি মাত্র সোয়া তিন মণ।’
একই উপজেলার আনন্দপুর গ্রামের কৃষক ওয়াহিদা ভূঁইয়ার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। তিনি জানান, ‘কম সার দেওয়া জমিতে শতাংশপ্রতি পেয়েছি পৌনে তিন মণ আলু। অন্যদিকে, বেশি সার ব্যবহৃত জমিতে পেয়েছি প্রায় তিন মণ।’
বাংলাবাজার গ্রামের কৃষক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘শুরুতে যখন কম সার ব্যবহার করি, তখন অন্য কৃষকরা হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু ফলন ভালো হওয়ায় এখন তারাই আমার কাছে পরামর্শ নিচ্ছে।’
খরচ কমিয়ে লাভের সম্ভাবনা
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে আসছেন। এতে উৎপাদন খরচ অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেড়ে যায়। প্রতি বছর সারের দাম বাড়ায় চাষে খরচও বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি। শতাংশপ্রতি তিন থেকে ছয় কেজি সার ব্যবহার করেও ভালো আলু উৎপাদন সম্ভব। যেখানে সাধারণ কৃষকরা ব্যবহার করেছেন ১২ থেকে ১৫ কেজি। ফলাফলে দেখা গেছে, বেশি সার দিলেও ফলনে খুব বেশি পার্থক্য নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি কৃষকরা এ পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তাহলে এক মৌসুমেই অন্তত ২৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এতে কৃষকদের লাভও বাড়বে।’
পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ
কম সার ব্যবহার শুধু খরচই কমাবে না, এটি পরিবেশের জন্যও উপকারী হবে। অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। এতে মাটির গুণগত মান নষ্ট হয়। তাই কম সারে ভালো ফলন কৃষকদের জন্য যেমন লাভজনক, তেমনি দীর্ঘ মেয়াদে মাটির স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।
মুন্সীগঞ্জের কৃষকরা এখন বুঝতে শুরু করেছেন যে, বেশি সার দিলেই ভালো ফলন হবে—এ ধারণা সঠিক নয়। বরং সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করলেই ভালো উৎপাদন সম্ভব। এবার পরীক্ষামূলকভাবে সফল হওয়ায় আগামীতে আরও কৃষক কম সার ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকতে পারেন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আশা করছেন, মুন্সীগঞ্জের এই অভিজ্ঞতা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আলু চাষিদের জন্যও দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।