
সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বলে প্রচার করা একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাছাড়া, ভারতের একটি সংবাদমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে রবিবার (১১ আগস্ট) দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে খবরও প্রকাশ হয়েছে। এটিও ভাইরাল। প্রকৃতপক্ষে এই দুটি খবরই ছিল ভুয়া।
এই বিষয় দুটি সামনে আসার পর বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানারের টিম এ নিয়ে অনুসন্ধান চালায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে কোনো খোলা চিঠি দেননি বরং ফেসবুক থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম হয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভুয়া এই চিঠির তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিঠিটির উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখতে পায়, গত ৫ আগস্ট বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে মো. রাকিব আকন নামে এক ব্যক্তি এর সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি করেছেন। পরবর্তীতে ভারতের আগরতলা ভিত্তিক দৈনিক পত্রিকা ‘ত্রিপুরা ভবিষ্যত’ এর প্রিন্ট সংস্করণেও এটি চিঠি আকারে তারিখ উল্লেখসহ প্রকাশের পর এর প্রিন্ট সংস্করণের স্ক্রিনশট ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘আমি পদত্যাগ করেছি, শুধু মাত্র লাশের মিছিল জেনো না দেখতে হয়। তোমাদের (ছাত্রদের) লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলো ওরা, আমি হতে দেয়নি, ক্ষমতা দিয়ে এসেছি। ক্ষমতায় আমি থাকতে পারতাম যদি সেন্টমার্টিন আর বঙ্গোপসাগর আমেরিকার কাছে ছেড়ে দিতাম। অনুরোধ রইলো তোমরা ব্যাবহার হয়ো না।
আমি বলে এসেছি আমার সোনার সন্তানদের যারা লাশ করে ঘরে ফিরিয়েছে তাদের জেনো বিচার করা হয়।
হয়তো আজ আমি দেশে থাকলে আরো প্রাণ ঝড়তো, আরো সম্পদ ধ্বংস হতো। আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি,
তোমাদের জয় দিয়ে এসেছি, তোমরা ছিলে আমার শক্তি, তোমরা আমাকে চাওনি, আমি নিজেই তখন চলে এসেছি, পদত্যাগ করেছি।
আমার কর্মিরা যারা আছেন, কেউ মনবল হারাবেন না। আওয়ামী লীগ বার বার উঠে দাড়িয়েছে। আপনারই দাড় করিয়েছেন। আশাহত হবেন না। আমি শিঘ্রয় ফিরবো ইনশাআল্লাহ। পরাজয় আমার হয়েছে কিন্তু জয়টা আমার বাংলাদেশের মানুষের হয়েছে। যে মানুষের জন্য আমার বাবা আমার পরিবার জীবন দিয়েছে। খবর পেয়েছি ইতিমধ্যে অনেক নেতা কর্মিকে হত্যা ও বাড়ি ঘরে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ করেছে।
আল্লাহ অবশ্যই আপনাদের সহায় হবেন।
আমি আমার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের আবারও বলতে চাই, আমি কখনই তোমাদের রাজাকার বলিনি। আমার কথাটা বিকৃত করা হয়েছে। ঐদিনের সম্পূর্ণ ভিডিও তোমাদের দেখার অনুরোধ রইলো।
তোমাদের বিপদগ্রস্ত করে একদল তার সুবিধা নিয়েছে। তোমরা ঠিকই তা একদিন অনুধাবন করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
ভালো থেকো আমার দেশের মানুষ, ভালো রেখো আমার সোনার বাংলাকে,
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু,
শেখ হাসিনা...’
যদিও পত্রিকা কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারের কাছে এটি তাদের পত্রিকায় ছাপা হয়নি বলে অস্বীকার করেছে। তবে পারিপার্শ্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে যে, এটি ওই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে।
তবে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই চিঠি নিয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
অন্যদিকে, রবিবার (১১ আগস্ট) ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনা তার পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে। যেটি শেখ হাসিনার চিঠির বক্তব্য বলে জানানো হয়। পরে এসব গণমাধ্যমের সূত্রে খবরটি বাংলাদেশের প্রায় সব গণমাধ্যমই প্রচার করা হয়।
অধিকাংশ গণমাধ্যমই সূত্র হিসেবে ভারতের দ্য প্রিন্ট এবং ইকোনমিক টাইমসের সূত্র দিয়েছে৷ তবে এই দুই গণমাধ্যমসহ ভারতের কোনো গণমাধ্যমই কথিত চিঠিটির মূল উৎস সম্পর্কে জানাতে পারেনি।
দ্য প্রিন্ট দাবি করেছে, শনিবার (১০ আগস্ট) এই চিঠি বা বার্তাটি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন। অথচ এর পাঁচদিন আগে থেকেই কথিত এই বার্তাটি ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারে পাওয়া যাচ্ছিল।
রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে ইকোনমিক টাইমস এবং দ্য প্রিন্টের সংশ্লিষ্ট দুই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এই চিঠির উৎস প্রসঙ্গে। তবে তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
একই সময়ে শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকেও বিষয়টি অবহিত করে সত্যতা জানার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার।
পরবর্তীতে জয় নিশ্চিত করেছেন, কথিত এই চিঠিটি তার মায়ের লেখা নয়। জয় বলছেন, “আমার মায়ের পদত্যাগের বিবৃতি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমি তার সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে তিনি ঢাকা ছাড়ার আগে বা পরে কোনো বক্তব্য দেননি।”
সুতরাং, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়েছেন, এটি ডাহা মিথ্যা।
অমিয়/