শহিদ নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে ছিল ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানার আলোচিত এই কর্মসূচি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ১৬টি দাবি যাচাই করে ১৫টি দাবি ভুয়া বলে চিহ্নিত করেছে। এগুলো মধ্যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি, ছবি ও ভিডিও রয়েছে, যা সাম্প্রতিক বলে প্রচার করা হয়।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার তিন মাস পর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম কর্মসূচির ডাক দেয় ১০ নভেম্বর। রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে দলটির বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আগের রাত (৯ নভেম্বর) থেকেই একাধিক অপতথ্যের প্রচার শুরু হতে দেখে রিউমর স্ক্যানার।
১০ নভেম্বর সারাদিন বিভিন্ন তথ্য, ছবি এবং ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্যের ছড়াছড়ি দেখা যায়। রিউমর স্ক্যানার এ সংক্রান্ত ১৬টি দাবি যাচাই করে ১৫টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে। এসব দাবির ক্ষেত্রে পুরোনো ছবি-ভিডিও যেমন ছিল, তেমনি ছিল সেনাবাহিনীকে জড়িয়েও ভুয়া তথ্যের প্রচার।
শহিদ নূর হোসেন দিবসে আওয়ামী লীগ যে কর্মসূচি দিচ্ছে তার আঁচ পাওয়া যায় গত ৮ নভেম্বর সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার কথিত ফোনালাপ ফাঁসের মাধ্যমে। এই ফোনালাপে শেখ হাসিনার কণ্ঠের আদলে একজনকে ১০ নভেম্বর দলীয় নেতা-কর্মীদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি হাতে মিছিল করার নির্দেশ দিতে শোনা যায়। যদিও আওয়ামী লীগের দাবি, এটি ভুয়া কল রেকর্ড।
ট্রাম্পকে জড়িয়ে কথিত এই নির্দেশনার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একই নির্দেশনার বিষয় উল্লেখ রেখে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে এমন একটি দাবির সঙ্গে দলটির দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার স্বাক্ষর সম্বলিত কথিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তির একটি ছবিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তবে যাচাই করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ দলটির প্যাডে দপ্তর সম্পাদকের স্বাক্ষর সম্বলিত কোনো বিজ্ঞপ্তিই দেয়নি। ১০ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে আগের দিন দলটির ফেসবুক পেজে নেতা-কর্মীদের পরদিন গুলিস্তানে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিতে আহ্বান জানিয়ে একটি পোস্ট করা হলেও তাতে ট্রাম্প বিষয়ক কোনো নির্দেশনা ছিল না।
আর ৯ নভেম্বর রাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্ল্যাকার্ডসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, অবৈধভাবে মিছিল ও সমাবেশের চেষ্টা করার সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তাছাড়া সামাজিক যোগাযােগমাধ্যমে গ্রেপ্তারদের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্স-এ একটি পোস্ট করেছেন এমন স্কিনশট ছড়িয়ে পড়ে। আদতে নির্বাচনে জয়ের পর বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ট্রাম্প কোনো এক্স পোস্টই করেননি। রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ট্রাম্পের নাম ব্যবহার করে তৈরি একটি ফ্যান অ্যাকাউন্টের স্ক্রিনশট ব্যবহার করে এই দাবি ছড়ানো হয়।
সেদিন রাতেই ১০ নভেম্বর শহিদ নূর হোসেন দিবস ঘিরে আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচি উপলক্ষে মঞ্চ নির্মাণের দৃশ্য দাবিতে কিছু ছবি প্রচার হয় ফেসবুকে। তবে অনুসন্ধান বলছে, এগুলো পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গত ৮ নভেম্বরে বিএনপির কর্মসূচির জন্য তৈরি মঞ্চের ছবি।
এসবের মধ্যেই ৯ নভেম্বর রাত থেকে ইন্টারনেটে ভাইরাল একটি ভিডিওকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউসহ ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের মিছিলের দৃশ্য দাবি করা প্রচার করা হচ্ছিল।
রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখতে পায়, ২০২০ সালে কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ছাত্রলীগ বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ভিডিও এটি।
১০ নভেম্বর প্রথম প্রহরে আওয়ামী লীগ আরেকটি কথিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। এটিও রিউমর স্ক্যানারের নজরে আসে। বিপ্লব বড়ুয়ার স্বাক্ষর সম্বলিত কথিত এই বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, দলটির ১০ নভেম্বরের কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নামে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও বানোয়াট বলে প্রমাণ পায় রিউমর স্ক্যানার।
শহিদ নূর হোসেন দিবস ঘিরে অপতথ্যের এই প্রবাহ জারি থাকে পরদিনও। এর রেশ ধরে সেদিন সকাল থেকে প্রচার হতে থাকে, সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সমাবেশে বাধা সৃষ্টি করবে না বলে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেছে। এই দাবির সূত্র হিসেবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) নাম উল্লেখ করা হয়৷
তবে আইএসপিআর রিউমর স্ক্যানারকে জানায়, সেনাবাহিনীর যে দায়িত্ব তাতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। আইএসপআর বলেছে, তাদের সূত্র দেখিয়ে যে দাবিটা প্রচার হচ্ছে তাও সঠিক নয়। আইএসপিআর এমন কোনো তথ্য দেয়নি।
সেদিন সকালে আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজের পোস্ট দাবিতে ‘কালকে সবাই ফোনের ওয়ালপেপারে ইউনুস এর ছবি দিয়ে রাখবেন’ শীর্ষক একটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে প্রচার করা হয়। তবে এমন কোনো পোস্ট বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে দেওয়া হয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধমে আলোচিত স্ক্রিনশটটি তৈরি করা হয়েছে।
দিনভর এই কর্মসূচি ঘিরে পুরোনো ভিডিওর ছড়িয়ে পড়াটা ছিল বেশ লক্ষ্যণীয়। কখনও আওয়ামী লীগের শোডাউনের সেদিনের দৃশ্য দাবিতে ২০২২ সালে নয়াপল্টনে ছাত্রলীগের মিছিল-শোডাউনের ভিডিও প্রচার, কখনও গত আগস্টে গোপালগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ মিছিলের দৃশ্যকে ঢাকা গণসমুদ্রে পরিণত হওয়ার দৃশ্য দাবি, কখনও আগস্টে ভারতে অবস্থান করা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে গোপালগঞ্জের বিক্ষোভ কর্মসূচির ভিডিওকে শহিদ নূর হোসেন চত্বরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিক্ষোভ সমাবেশের ভিডিও দাবি, কখনও গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের গমনের দৃশ্যকে নারায়ণগঞ্জের পুরোনো ভিডিও প্রচার, কখনো-বা ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের ছাত্র সমাবেশের ভিডিওকে জিরো পয়েন্টে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের যোগ দিতে যাওয়ার ঘটনার দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। এসব ভিডিও সেদিন মুহূর্তের ব্যবধানে অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।
ভিডিও ছাড়াও পুরোনো ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই কর্মসূচির অপপ্রচার চালানো হয়। চলতি বছরের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ফেসবুক পেজে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সব শহিদের স্মরণে খতমে কোরআন ও দোয়া মাহফিল এবং শোক র্যালির আয়োজন করার ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখান থেকে একটি ছবি নিয়ে দাবি করা হয়, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সমাবেশস্থল জিরো পয়েন্ট দখলে নেওয়ার দৃশ্য এটি।
অপতথ্যের প্রচারে ইউটিউবও পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে রাজনৈতিক অপতথ্যের প্রচারে সাম্প্রতিক বছরে ইউটিউব হয়ে উঠছে চিন্তার কারণ। আলোচিত কর্মসূচীতেও ইউটিউবে অপতথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। তাজা নিউজ নামের একটি চ্যানেল থেকে ১০ নভেম্বর একটি ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করা হয়, সমন্বয়কদের পিটিয়ে সমাবেশস্থল দখলে নিয়েছে আওয়ামী লীগের লাখো নেতা-কর্মী। এই ভিডিওটি চার লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে। অথচ, এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
চটকদার শিরোনাম ও থাম্বনেইল ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার একাধিক পুরোনো ভিডিও ও ছবি যুক্ত করে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনার মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।
১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিহত করতে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অবস্থান নেয়। এ দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে সময় টেলিভিশন। গণমাধ্যমটির এই ফুটেজ ব্যবহার করে দাবি করা হয়, আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমেছে এবং নূর হোসেন চত্বরে জড়ো হচ্ছে।
আলোচিত এই কর্মসূচি ঘিরে যে ১৫টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে তথ্যকেন্দ্রিক দাবি ছিল দুইটি, ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছিল দুইটি, পুরোনো ছবিকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে একটি, পুরোনো ভিডিওকে সাম্প্রতিক দাবিতে প্রচার করা হয়েছে ৯টি এবং কর্মসূচির দিনের ভিডিওকে বিভ্রান্তিকর দাবিতে প্রচার করা হয়েছে একটি।
অমিয়/