বিকেলটা ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। সন্ধ্যা নামতেই মেঘ গুড়গুড় আষাঢ় স্বরূপে প্রকাশিত। শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজারে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে যারাই এসেছিলেন বেশির ভাগের হাতেই ছিল ছাতা। যাদের ছাতা নেই, তাদের গায়ে-কাপড়ে বৃষ্টির ফোঁটা। ঠিক সন্ধ্যা ৭টায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৈশোর থেকে পাঠ করা শুরু করলেন প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক প্রীতম সেনগুপ্ত। ভারতীয় এই সাধক-গবেষকের কথাই ছিল রবীন্দ্রনাথের গানের গল্প। গায়ক রবীন্দ্রনাথকে জানতে পাঠের শুরুতেই তিনি উপস্থিত দর্শকদের বলে দিলেন পাঠের পর বা গানের পর কেউ যেন করতালি না দেন। তালি দিয়ে অনুষ্ঠানের তাল নষ্ট না করার বিনয়ী অনুরোধ জানালেন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়। রবীন্দ্রনাথের গান ও গল্পকথায় রবীন্দ্রময় আষাঢ়সন্ধ্যা গড়ায় রাত পর্যন্ত।
গত শনিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের সূচনা রবীন্দ্রনাথের জীবনালেখ্য বিষয়ে গবেষক প্রীতম সেনগুপ্তের পাঠের মধ্য দিয়ে। ‘কবি তখন তার মধ্য কৈশোরে। ইতোমধ্যেই উপনয়ন হয়ে গিয়েছে। পিতৃদেবের সঙ্গে হিমালয়-যাত্রা সেরে ফিরেও এসেছেন। ফিরে সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হয়ে তিন মাস পর স্কুলের পাট চিরকালের মতো অসমাপ্ত রেখে স্কুল ত্যাগ করেছেন। ততদিনে শিখ-ভজন ভেঙে একটি ব্রহ্মসংগীত রচনা তার ঝুলিতে সঞ্চয় হয়েছে। মাতা সারদা দেবীকে হারিয়েছেন। ম্যাকবেথ, কুমারসম্ভব, শকুন্তলা অনুবাদ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন দাদার ‘সরোজিনী’ নাটকের জন্য গান রচনা করেছেন। আবার পাশাপাশি এই কালেই পিতার সঙ্গে শিলাইদহে তার প্রথম যাত্রা। শুধু তো যাওয়া নয়, সঙ্গে রয়েছে ‘গীতগোবিন্দ’। নিজেই বলেছিলেন সেই যাত্রাপথের কথা। “একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা স্লেট লইয়া লিখিলাম ‘গহন কুসুম-কুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম।”
এসব কথামালার ব্যাপ্তি ছিল ৫ মিনিট। পাঠের পর শুরু হয় সংগীত। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জয়ীতা তিথি গান ধরলেন ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথয়ামিনী রে...।’ মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতা। গান শেষে আবারও রবীন্দ্র পাঠ। জানা গেল, আমাদের এই দুই বাংলার যত ঋতুবৈচিত্র্য আছে, সব ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের লেখায়। ঋতুভিত্তিক মোট ২৮৩টি আর বর্ষার ১১৫টি গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৬ বছর বয়সে বর্ষার প্রথম গান লেখেন। বর্ষার গান বেশির ভাগ লিখেছেন ৬০ বছর বয়সের পর।
এমন আরও নানা তথ্য ও গল্প ছিল পাঠে। এসব পাঠের মাধুর্য বাড়ায় সংগীতশিল্পী জয়ীতা তিথির গাওয়া ১৩টি রবীন্দ্রসংগীত। ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে’ গানে শেষ হয় ২ ঘণ্টাব্যাপী ‘রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ঋতু বর্ষায় গল্প-গানে আষাঢ়সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান।
সিলেটকে বলা হয় বৃষ্টির শহর। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার অনেক লেখায় সিলেটকে বৃষ্টির শহর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারও অনেক আগে রবীন্দ্রনাথের পদস্পর্শধন্য হয়েছিল সিলেট। তার গান ও গল্পগাঁথার এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আষাঢ়ের সন্ধ্যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আগমন হৃদয় দিয়ে উপভোগ করেছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত রবীন্দ্রসংগীতপ্রিয় মানুষজন। আয়োজন নিয়ে এভাবেই বলছিলেন অনুষ্ঠান আয়োজক ‘চৈতন্য প্রকাশন’-এর স্বত্বাধিকারী রাজীব চৌধুরী। চৈতন্য প্রকাশন আয়োজিত ‘বহুযুগের ওপার হতে আষাঢ় এল’ শীর্ষক এ আয়োজনের সর্বশেষ ধাপের অনুষ্ঠান ছিল সিলেটে। এর আগে রাজধানী ঢাকায় ও সংস্কৃতির শহরখ্যাত সুনামগঞ্জে দুটো অনুষ্ঠান হয়েছে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে অতিথিদের ফুল ও উত্তরীয় দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। মঞ্চসজ্জা করেন অরূপ বাউল। বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ পাঠক ও উপস্থাপক জান্নাতুল নাজনীন আশার সঞ্চালনায় সংক্ষিপ্ত সূচনা পর্বে বক্তৃতায় রাজীব চৌধুরী বলেন, “আমরা মূলত বই প্রকাশনা নিয়ে কাজ করি। এ ধরনের সাংস্কৃতিক আয়োজন এবারই প্রথম করেছি। গত ২ জুলাই ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমরা ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল’ শীর্ষক রবীন্দ্র গল্প-গানের আয়োজন করি। এরপর গত ৫ জুলাই সুনামগঞ্জের শিল্পকলা একাডেমির হাসন রাজা মিলনায়তনে আমাদের দ্বিতীয় আয়োজন ছিল। সিলেটের এই আয়োজনের মাধ্যমে শেষ হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতি আমাদের নিবেদন।”