স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে ‘গণতন্ত্র’ বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সে লক্ষ্যে নাগরিকের মৌলিক ও মানবিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্র সর্বতোভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা খুব বেশি টেকসই হয়নি। তাছাড়া যুগের পরিবর্তনে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রের কাছে সাধারণ নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তাই সংবিধানের মূল চেতনাকে সামনে রেখে সময় ও বাস্তবতার নিরিখে রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থায় টেকসই সংস্কার প্রয়োজন। আমি মনে করি সেই ধরনের টেকসই সংস্কার করার জন্য এটাই উৎকৃষ্ট সময়। কারণ, দলীয় সরকারগুলো তাদের স্বার্থ বিবেচনায় সংস্কার করে থাকে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের নানা প্রসঙ্গ ও প্রস্তাব রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষক, সিভিল সমাজ এমনকি বৃহত্তর জনপরিসরে ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। সে নিরিখে অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদের ‘সংস্কার সংলাপ: সূচনা সূত্র’ শিরোনামের বইটি মধ্যে দেওয়া পাঁচটি সংস্কার প্রস্তাব বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্রায়ণ ও রাষ্ট্র মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস এবং তা সাধারণ নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে অনেকাংশে সহায়ক হবে বলে অনেকেই মনে করেন।
যে প্রস্তাবগুলো ড. তোফায়েল আহমেদ তার রচনায় তুলে ধরেছেন তা হলো- ১) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান; ২) দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন; ৩) জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতি প্রণয়ন ও তার আলোকে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস; ৪) একটি একীভূত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান আইন ও একক তফসিলে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠান; ও ৫) ভোটার অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি’ চালু এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ দান। প্রস্তাবগুলো সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হল।
প্রস্তাব এক: সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান
বাংলাদেশের নির্বাচন সংস্কৃতি খুব একটা সুখের নয়। বাংলাদেশে চলমান নির্বাচন পদ্ধতি ‘মেজরিটারিয়ান’ নামে পরিচিত এবং এ পদ্ধতির নির্বাচনই আইন সম্মতভাবে বাংলাদেশে গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু বিগত ৫০ বছরেও বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন ঘটেনি, বরঞ্চ পরিস্থিতি ক্রমাবনতিশীল। তাছাড়া নির্বাচনে ব্যবস্থাপনাগত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিগত সীমাবদ্ধতা, যা ছিল তা এখন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। তাই এখন নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন না করে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে বলে লেখক মনে করেন। লেখকের মতে বিশ্বের প্রায় ৮৭টি রাষ্ট্র সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে অধিকতর যুক্তিসংগত ও সমতাভিত্তক সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যার সুফল তারা ভোগ করছে। সেই অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে লেখক বাংলাদেশে প্রচলিত সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভিত্তিক (Simple Majoritarian) নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার পূর্বক অধিকতর যুক্তিসংগত ও সমতাভিত্তক সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (Proportional Representation)-এর নির্বাচন পদ্ধতি গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে অনুসৃত সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্বাচন পদ্ধতির সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য একটি উত্তম প্রস্তাব বলে মনে হয়েছে। কারণ, এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রত্যেকটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। তাছাড়া একটি নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা ও হারের ভিত্তিতে সংসদে আসন বণ্টন হয়।
কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থায় পৃথক পৃথকভাবে নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক একক প্রার্থীর সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিজয়কে সংযুক্ত করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন হিসাব করে সরকার গঠন করা হয়, যা মোট ভোটের হিসাবে সংখ্যালঘিষ্ঠেরই শাসন। অথচ গণতান্ত্রিক নীতি অনুযায়ী আমরা চাই সবসময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। যেহেতু নির্বাচনি গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার জন্য আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশ এ পদ্ধতি চালু করে সুফল পেয়েছে, তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন পদ্ধতির এই ধারণাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পারেন। লেখকের এই মন্তব্য আমার কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। ড. আহমদ তার বইতে এর বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছেন এবং বিশ্বের প্রায় ৯৭টি দেশে কী কী পদ্ধতিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব প্রয়োগ হয় তার একটি তালিকা সংযোজন করেছেন।
প্রস্তাব দুই: দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন
বর্তমান বিশ্বের আইনসভার ধরন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধ ধারণকারী দেশগুলো অর্থাৎ যেখানে আইনসভা সত্যিকার অর্থে কার্যকর সেখানকার আইনসভাগুলো দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। এমনকি আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, ভুটান, পাকিস্তান ও নেপালের আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। পৃথিবীর সব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দুটি কক্ষের মাধ্যমে সংসদীয় কর্মপ্রক্রিয়ায় ভারসাম্য আনয়ন করা হয়। গবেষকরা বলছেন, সাধারণত দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা তুলনামূলকভাবে বেশি সুবিধাজনক। সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশেও দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা প্রবর্তনের চিন্তা করা যায়। লেখক বাংলাদেশে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় পদ্ধতি চালু করে, এতে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন। আমার কাছে এই প্রস্তাব খুবই যুক্তিসংগত মনে হয়েছে। কারণ, সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন এবং দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইন সভা প্রবর্তন হলে জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভূমিকা ও কাজের ধারায় আমূল পরিবর্তন আসবে, যা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অনেক বেশি কার্যকর হবে বলে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া, এই ধারণার প্রবর্তন হলে জাতীয় সংসদ সদস্যদের সব কাজ হবে জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে, দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ বিবেচনায় আসবে না। ফলে রাজনীতি ও দলীয় ব্যবস্থায় তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন উপাদান সংযুক্ত হবে আমি বিশ্বাস করি, যা আমাদের মতো দেশের জন্য খুবই দরকার।
প্রস্তাব তিন: জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতি প্রণয়ন ও তার আলোকে শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস
বর্তমান আধুনিক সময়ে ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ রাষ্ট্রীয় শাসন, সেবা-সরবরাহ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে নতুন ধারণা ও দিগন্তের উন্মোচন করেছে। কিন্তু সনাতনী রাজনীতি ও লোকপ্রশাসন ব্যবস্থায় বিকেন্দ্রীকরণ শুধু ‘সরকারের কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে ওপর থেকে নিচে হস্তান্তরকে’ নির্দেশ করে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ও রাজনৈতিক কাঠামো অতি কেন্দ্রায়িত। এখানে প্রদেশ না থাকলেও রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সীমিত প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন বি-পুঞ্জিভূতকৃত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সুবিশাল একটি সাংগঠনিক কাঠামো, যা সনাতনী বিকেন্দ্রীকরণ ধারণায়পুষ্ট। কিন্তু বর্তমান আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে সুশাসনের কথা এবং আইনের শাসনের কথা জোরেসোরে উচ্চারিত হয়, সেখানে পরিপূর্ণ ‘বিকেন্দ্রায়ণ’ অতীব জরুরি। বাংলাদেশে কেন্দ্রায়ণ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, তা আর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, ব্যক্তির খেয়াল-খুশিনির্ভর হয়ে পড়েছে। স্বচ্ছতা আর জনজবাবদিহি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সর্বত্র এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই একটি জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতি প্রণয়ন করা অতীব জরুরি, যা প্রশাসনিক কেন্দ্রায়ণ নিরসন করে সরকারের ক্ষমতা ও কর্মযজ্ঞকে দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গে সঞ্চালিত করবে এবং সব কাজের সুষম ও স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনবে। আমিও এই প্রস্তাবের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত। লেখকের মতে, জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতিকে হতে হবে দেশের রাজনীতি, শাসন কাঠামো এবং নানান ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সামষ্টিক রূপরেখা হিসেবে। সংবিধানের মূলনীতি ও অন্যান্য নির্দেশনা এ নীতিতে প্রতিফলিত হতে হবে। কিন্তু আমাদের সংবিধান কেন্দ্রায়িত শাসনের নীতিকে উৎসাহিত করে। তাই বিকেন্দ্রায়ণের সবগুলো ধরন ও ধারণার যুগপৎ প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতির প্রবর্তন করা দরকার।
বিকেন্দ্রায়ণের বেসরকারীকরণ নীতিমালা সুচিন্তিতভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সরকার দৈনন্দিন অনেক কাজের ভারমুক্ত হয়ে অনেক বেশি নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তদারকি কাজে মনোযোগী হতে পারবে, জনবল কমিয়ে সরকারের আকার ছোট ও স্মার্ট করতে পারবে এবং সমাজের সর্বত্র ক্ষমতায়ন হবে ও সমাজের সার্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আমিও এই বক্ত্যব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তাছাড়া আইনের শাসন নিশ্চিত করার একটি প্রধানতম হাতিয়ার হলো ক্ষমতার সুষম বিকেন্দ্রীকরণ এবং আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের কাজের পৃথকীকরণ। রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালনার লক্ষ্যে সংবিধানের চিহ্নিত নানা সীমাবদ্ধতা সংশোধন করে তার আওতায় নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করেই জাতীয় বিকেন্দ্রায়ণ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কারণ এখানে প্রথম দুটি পদক্ষেপ তৃতীয় পদক্ষেপের পূর্বশর্ত। লেখকের মতো আমাদের অনেকেরও বিশ্বাস এই তিনটি নীতিগত সংস্কার বাংলাদেশে একটি টেকসই, নাগরিক বান্ধব, বৈষম্যহীন, ও জনকল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পুনর্গঠনকে নির্বিঘ্ন করবে।
প্রস্তাব চার: একটি একীভূত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান আইন ও একক তফসিলে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠান
লেখকের মতে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নানা কারণে জটিল, ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বর্তমান চলমান স্থানীয় সরকার কাঠামো গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা চর্চার অনুকূল না হওয়ায় একদিকে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে তা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারছে না, অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা চর্চায় থাকছে না যুগোপযোগী ভারসাম্য। প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ছে দুর্বল। তাই আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাঠামোকে সংস্কার করে নির্বাচন পদ্ধতি সহজীকরণ এবং সাংগঠনিক কাঠামোকে ভারসাম্যপূর্ণ করা প্রয়োজন। আমিও মনে করি বিষয়টি বর্তমান নির্ধারকদের গভীর মনোযোগ দাবি করে। লেখক স্থানীয় সরকারের সব প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি ‘একক তফসিলে’ সর্বাধিক এক মাস বা ৪৫ দিন সময়ে শেষ করার একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। আমি মনে করি স্থানীয় নেতৃত্ব বিকাশে এবং সময় ও ব্যয় সংকোচনে এই প্রস্তাব খুবই সহায়ক হবে এবং স্থানীয় জবাবদিহি বৃদ্ধি করবে।
প্রস্তাব পাঁচ: ভোটার অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনে ‘পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি’ চালু এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার চর্চার সুযোগ দান।
বাংলাদেশে পোস্টাল ব্যালট ও প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়েগের কোনো সুযোগ নেই। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র চর্চায় এ দুটি বিষয়ে বিপুল উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। তাই ভোটার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য উদারভাবে ‘পোস্টাল ব্যালট’ ব্যবস্থা এবং প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দানের ব্যবস্থা চালু করা দরকার। লেখকের মতে বাংলাদেশেও সীমিতভাবে ডাকযোগে ভোটদানের আইন আছে (অনুচ্ছেদ ২৭, জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২, যা ২০১৯ সনে সংশোধিত, অনুচ্ছেদ ৮(৩) ও (৫), ভোটার তালিকা আইন ২০০৯, যা ২০১৯ সালে সংশোধিত)। সশস্ত্র বাহিনী, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য কর্মীদের জন্য এ অধিকার সংরক্ষণ করা হলেও পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে কেউ খুব এটা আগ্রহ দেখা যায় না, তাই বাস্তব চর্চা খুবই সীমিত। এ বিষযে নানা সেমিনারের আলোচনায় বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী লেখকের সঙ্গে এই বিষয়ে একমত এবং এই ব্যবস্থা সবার জন্য প্রযোজ্য করে চালু করা দরকার বলে মনে করে।
সারকথা
বাংলাদেশকে প্রথমত উন্নয়নশীল ও পরে উন্নত দেশে উত্তরণের উপযোগী উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি সহায়ক স্থানীয় শাসন কাঠামো বিনির্মাণের স্বার্থে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্বিন্যাস ও আধুনিকায়ন করা খুবই প্রয়োজন। এই পুনর্বিন্যাস ও আধুনিকায়নের জন্য যে ৫টি বিষয়ের প্রতি লেখক মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, আমিও তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। বিশেষ করে, স্থানীয় সরকারে গ্রাম ও নগরের বিভক্তি ও স্তর সংখ্যা হ্রাস, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের একটি একক আইন প্রণয়ন, রাষ্ট্রপতি আদলের পরিবর্তে সংসদীয় আদলের স্থানীয় সরকার কাঠামোর প্রবর্তন, নারীর আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আবর্তন পদ্ধতির প্রবর্তন, একক তপসিলে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এবং গ্রামীণ পৌরসভাগুলোর বিলুপ্তি। প্রতিটি প্রস্তাব অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং যুগোপযোগী বলে মনে হয়।
তবে, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় পর্যায়ে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নেই। রয়েছেন একজন বিভাগীয় কমিশনার। এখানে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে থাকা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মতো একজন নির্বাচিত বিভাগীয় পরিষদ চেয়ারম্যান থাকা দরকার বলে আমি মনে করি। এতে করে মাঠ পর্যায়ের শাসন ও প্রশাসনে ভারসাম্য আসবে। অন্যদিকে ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশাসন পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ মাঠ প্রশাসনের কোনো প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা নেই। যেহেতু ইউনিয়ন হলো বাংলাদেশের মাঠ প্রশাসনের এবং স্থানীয় শাসনের কেন্দ্রবিন্দু, সেহতু, এখানে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা থাকাও দরকার বলে আমি মনে করি। আমি মনে করি স্থানীয় শাসন ও প্রশাসন ব্যবস্থায় এই দুই সংযোজন বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণে খুবই কার্যকর হবে। তাছাড়া গণতন্ত্রের ভীত অধিকতর টেকসই হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি। কিন্তু এখনো গণতন্ত্র আমাদের দেশে পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাইনি। যুগে যুগে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক গণতন্ত্রের জন্য রক্ত দিয়েছে। তাছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম যাকে আমরা জেনারেশন-জি বলছি, তারা যে উদ্দেশে জুলাই বিপ্লব সাধন করেছে তার বাস্তবায়ন অতীব জরুরি। তারা রক্ত দিয়েছে একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও উন্নত বাংলাদেশের জন্য। যেখানে আমাদের দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে। আর তাদের এই আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দানের জন্য টেকসই গণতন্ত্র অত্যাবশ্যকীয়। আমরা মনে করি, আমাদের এখন সময় এসেছে পারস্পরিক সামঞ্জস্যহীন ও প্রায় অকার্যকর চলমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচনি ব্যবস্থার কাঠামোগত এবং পদ্ধতিগত সংস্কার করার। আমাদের আরও মনে হয় উল্লেখিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো যদি বর্তমান সরকার বিবেচনায় রাখেন তাহলে আমরা একটি টেকসই গণতন্ত্র চর্চার সোনালি দিনে ফিরে যেতে পারব, পারব, জন আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে এবং পারব একটি বৈষম্যহীন, ক্ষুধামুক্ত ও উন্নত বাংলাদেশ উপহার দিতে।
(এ রচনাটি প্রফেসর তোফায়েল আহমেদের ‘গ্রন্থিক প্রকাশনী’ থেকে ২০২৪ এ প্রকাশিত ‘সংস্কার সংলাপ: সূচনা সূত্র’ গ্রন্থটির প্রথমাংশ অবলম্বনে রচিত)
লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।