সর্বান্তঃকরণে বঙ্গজ সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে শুদ্ধ বাঙালি হওয়ার ব্রত নিয়ে বন্ধুর পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। কৈশোরে দেখেছেন পাকিস্তানের সামরিক শাসন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙবে বলে তখন বাঙালির ধনুকভাঙা পণ। সেই স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করতে সন্জীদা খাতুন কণ্ঠে তুলে নিলেন গান। তার কণ্ঠে দেশমাতৃকার গান অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে একাত্তরের রণাঙ্গনে।
সন্জীদা খাতুন থেমে থাকেননি। সর্বান্তকরণে বাঙালি হওয়ার ব্রত নিয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে হেঁটে বেড়িয়েছেন গানের ডালি নিয়ে। কথা-তাল-সুরে অন্তরের শুভবোধকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। বাংলা সংস্কৃতির ধারাকে রুখে দিতে যত প্রতিবন্ধকতা এসেছে, তার বিপরীতে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনিও বারবার বলেছেন, ‘আমার এই পথ চলাতে আনন্দ’। ঝঞ্ঝা আসুক কিংবা হঠাৎ দুর্বিপাক, সংস্কৃতিজনদের নিয়ে সন্জীদা খাতুন লড়াই করেছেন অবিরাম। বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ‘ছায়ানট’-এর সমার্থকই যেন হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘মিনু আপা’। সংস্কৃতিজনের ভাষ্যে, তাদের ‘মিনু আপা’ এক মহীরুহ; দেশ ও মাটির প্রতি টান যাকে নিয়ে গেছে অনতিক্রম্য উচ্চতায়।
বিধাতার নিয়মানুসারে সবাইকে একদিন থামতে হয়। মহাকাল যতিচিহ্ন এঁকে দেয় আয়ুরেখায়। সন্জীদা খাতুনকেও থামতে হলো। ৯২ বছর বয়সে থেমে গেল তার পথচলা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ছায়ানটের এই সভাপতি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার পুত্রবধূ ও ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় সন্জীদা খাতুনের লাশ ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে আনা হবে। তার মৃত্যুতে দেশের সংস্কৃত অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
এক জীবনে সন্জীদা খাতুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে ড. সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তিনি।
সন্জীদা খাতুন রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসংগীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’। রবীন্দ্র বিষয়ক তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’। একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ এবং শিক্ষক সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্র চর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রসারে অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো সন্জীদা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী প্রবর্তিত দেশিকোত্তম সম্মাননায় ভূষিত হন। ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যখন উত্তুঙ্গে, সন্জীদা খাতুন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে নিহত হন। পরের দিন পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনে নারীদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তৃতা করেন সনজীদা। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’
বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে কবি সুফিয়া কামাল, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক আর সংস্কৃতি-সংগঠক আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি-অঙ্গন ছায়ানট। ছায়ানটের প্রথম কমিটিতে যুক্ত হন সন্জীদা খাতুন। সে সময় তিনি শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।
অর্ধশতাব্দীকালের নিরলস সাধনায় বাংলা নববর্ষ উৎসবকে তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়েছেন। ২০০১ সালে রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের উৎসবে বোমা-হামলার পরেও ছায়ানট থেমে থাকেনি। সংস্কৃতিজনদের ভাষ্যে, ‘মিনু আপার অমিত সাহসেই ছায়ানট ভীত না হয়ে এগিয়ে গেছে।’ অশুভর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম ছিল সন্জীদা খাতুনের। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুরকে হাতিয়ার করে সম্প্রীতির বন্ধনে তিনি বাঁধতে চেয়েছেন মানুষকে।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে সন্জীদা খাতুন ব্রতী হয়েছিলেন শুদ্ধ মানুষ গড়ার সংগ্রামে। সেই কাজটি করতে পেরেছেন বলে জীবনকে অর্থবহ মনে করেছেন তিনি। ২০২৩ সালে নিজের ৯১তম জন্মদিনের আয়োজনে তিনি বলেছেন, ‘সেই- যে ছেলেবেলায় সবার মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা, তা পূর্ণ হতে পেরেছে এইভাবে। শিশুদের জন্য, দেশের জন্য বাঙালি জাতির জন্য কাজ করে আমার জীবনটা অর্থবহ হয়েছে বলে মনে করি। অল্পে তুষ্ট সহজ-সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।’ নবতিপূর্ণা সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের সেই আসরে গাইলেন তার শৈশবে শেখা প্রিয় গান ‘তৃষ্ণার জল এসো এসো হে’।
সেই সর্বশেষ জনসমক্ষে আসেন সবার প্রিয় ‘মিনু আপা’। বার্ধক্যজনিত নানা অসুখের পাশাপাশি তিনি কিডনির সংক্রমণে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরে।
ড. সন্জীদা খাতুনের জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সন্জীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থে আটটি বিভাগে প্রায় ৬০ জনের লেখায়। সেখানে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে, দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে। আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।’
ড. সন্জীদা খাতুনের প্রয়াণে শোক জানিয়েছে বাংলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতীয় পার্টি, সিপিবি।