পয়লা কার্তিক বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) আধ্যাত্মিক সাধক ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৪তম তিরোধান দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে এখন সাধুগুরুদের মিলনমেলা। এ দিন সকালে ভক্তিসংগীত আর অধিবাস সেবার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাধুসঙ্গ। আর সন্ধ্যায় মূলমঞ্চের আলোচনা সভার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার।
বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া এই স্মরণোৎসব চলবে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত।
এদিকে প্রার্থনামূলক পদ-পদাবলি আর গানের বাণীতে লালনকে স্মরণ করছেন সাধু-বাউল ও ভক্তরা। সাধু-ফকিররা বলছেন, সাঁইজিকে অনুকরণ করতেই তারা কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে এসেছেন। গুরুকাজ ও সাধুসঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে চলছে সাধন-ভজন।
১৩৪ বছর আগে এই ছেঁউড়িয়ায় দেহ ত্যাগ করেন ফকির লালন সাঁই। গুরু পরম্পরায় তার মানবদর্শন ধরে রেখেছেন সাধু-ফকিররা। সেই থেকে দৌল পূর্ণিমার সাধুসঙ্গের মতোই আয়োজনে থাকে অধিবাস, বাল্যসেবা ও পূর্ণসেবা।
সাধু-ফকিররা বলছেন, গুরু-শিষ্যের অষ্টপ্রহরের এ মিলনমেলার সবকিছু সাঁইজিকে ঘিরে, তাকে অনুকরণ করতেই। সব সাধনা যেন মানুষ ভজনের।
আখড়াবাড়িতে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে আসছে, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ লালন অনুসারীদের মতে, মানুষকে ভজে বা মানুষের সেবা করে সোনার মানুষ হওয়া যায়। এ জন্যই দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লালনভক্ত, অনুসারী ও বাউল সাধুরা বছরে দুবার এই বারামখানায় আসেন।
লালনপ্রেমে দেশ ছেড়ে কুষ্টিয়ায় এসে মানবধর্মের প্রতি অনুগত হয়ে সংসার পেতেছেন ফ্রান্সের দিবোরা জান্নাত। এখন তিনি ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে গবেষণা করছেন। এবারের তিরোধান দিবসে কথা হয় দিবোরার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘মনের মানুষ যেখানে থাকে সেখানেই শুধু শান্তি পাওয়া যায়। তাই আমার মনের মানুষ আমার গুরু, আমার সাঁইজির খোঁজে আমি এখানে এসেছি।’
অধিবাস, বাল্যসেবা ও পূর্ণসেবার পর অষ্টপ্রহরে শেষ হয় এই স্মরণোৎসব। সকাল থেকেই লালনের আখড়াবাড়ির প্রাঙ্গণে চলছে তার বাণীর প্রচার। আখড়াবাড়িজুড়ে শুধুই একতারার টুংটাং শব্দ এবং ফকিরি গানের মূর্ছনা, যা মুগ্ধ করছে হাজারও দর্শনার্থীকে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা সাধু-গুরুভক্ত অনুসারীরা বলছেন, গুরু-শিষ্যের এ মিলনমেলার সবকিছু সাঁইজিকে ঘিরে। কারণ ভালোকে দেখেই চেষ্টা চলে ভালো হওয়ার।
জানতে চাইলে ফকির আলাউদ্দিন সাঁই বলেন, ‘শান্তির জন্য একটাই পথ, সেটা হলো সাঁইজির মানবধর্মের বাণীকে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সাংসারিক জীবনে বাসনার কারণে হানাহানি, মারামারি, অশান্তি বেড়েই চলেছে। আমরা মনে করি, আরেকজন না থাকলে তার জিনিস আমার হয়ে যাবে। আসলে আমি আমার বলে যে জিনিস মনে করছি, তা আমার না! আমরা যার জন্য হানাহানি করছি আসলে তার সব কিছুই থেকে যাবে, কিন্তু আমি থাকব না। তাই সম্পদের জন্য হিংস্র হওয়া যাবে না।’
খণ্ড খণ্ড বৈঠকি আবেশে পুরো আখড়াবাড়িতে গানে গানে প্রচার করা হচ্ছে লালনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। জাতপাতহীন লালনের এই বাণীই পারে সমাজে শান্তি ফেরাতে, এমনটিই মনে করেন বাউল-সাধকরা।
স্মরণোৎসবকে কেন্দ্র করে মূলমঞ্চে চলছে দেশের স্বনামধন্য লালনশিল্পীদের কণ্ঠে সংগীতের পরিবেশন, যা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। অন্যদিকে কালীনদীর বিশাল মাঠজুড়ে বসেছে গ্রামীণ মেলা। সেখানে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।
সার্বিক বিষয়ে কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার বলেন, তিন দিনের এই বিশাল আয়োজন যাতে সফলভাবে শেষ হয়, সে জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে আগত দর্শনার্থী ও লালন অনুসারীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নেওয়া হয়েছে কঠোরব্যবস্থা।