
‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে/ (জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি/ বিরাম) মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত/ দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন/ যশোরে সাগরদাঁড়ী-কবতক্ষ-তীরে/ জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি,/ রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
কবিতায় এভাবেই নিজের পরিচয় দিয়ে গেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশিষ্ট বাঙালি কবি ও নাট্যকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের প্রবর্তক তিনি। একাধারে আখ্যানকাব্য, গীতিকাব্য, পত্রকাব্য, সনেট, প্রহসন ইত্যাদি রচনার সূত্রে মহাকবি ও ‘মধুকবি’ নামে খ্যাতিমান। আজ ২৫ জানুয়ারি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কবির ২০১তম জন্মদিন।
এদিকে কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও কবির জন্মভূমি যশোরের কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে সাত দিনব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল ২৪ জানুয়ারি মধুমেলার উদ্বোধন করা হয়। মেলায় প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত মধুমঞ্চে চলবে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক ও যাত্রাপালা। কবির জন্মদিন ঘিরে মধুপ্রেমীদের আগ্রহ এবারও তুঙ্গে। দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ প্রচুর দর্শনার্থী মেলায় আসছেন।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। শীতের ছোঁয়া সাগরদাঁড়ির প্রকৃতিজুড়ে। ভেতর বাড়ির এক কোণের একটা ঘরে শোনা গেল উলুধ্বনি-শঙ্খধ্বনি। কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা জাহ্নবী দেবী আঁতুরঘরে পুত্রসন্তান প্রসব করেছেন। বেশ কয়েক দিন কাটল আনন্দ উৎসবে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে নাম রাখা হলো মধু- শ্রী মধুসূদন দত্ত। রাজনারায়ণ দত্ত ও জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান ছিলেন তিনি।
মধুমেলায় প্রাণের উচ্ছ্বাস
প্রতিবছরের মতো এবারও সাত দিনব্যাপী ‘মধুমেলা’ আয়োজন করেছে জেলা প্রশাসন। শতবর্ষী এ মেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়িকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মধুভক্তের উপস্থিতিতে এবারও মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। কবির স্মৃতিবিজড়িত কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী অঞ্চল, জমিদার বাড়ির আম্রকানন, বুড়ো কাঠবাদামের বৃক্ষতলা, বিদায় ঘাট, মধুপল্লিসহ মেলা প্রাঙ্গণে প্রতিদিন মধুভক্তদের পদচারণে ইতোমধ্যে সরগরম হতে শুরু করেছে।
দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য ৯ দিনব্যাপী সাগরদাঁড়ির মধুমঞ্চে কবিকে ঘিরে আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্যান্ডেলে সার্কাস, জাদু প্রদর্শনী ও মৃত্যুকূপের আয়োজন রয়েছে। মেলা উপলক্ষে এলাকার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। মেলা প্রাঙ্গণেই শুধু এ মেলার বিস্তার নয়। মেলা উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে জামাই আর আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে খই, মুড়কি, নারকেল আর চালের আটার নাড়ুসহ নানা রকমের পিঠা বানানো হয়েছে। মেলায় সদলবলে এসে মিষ্টি-মিঠাই কিনে বাড়িতে ফেরার রেওয়াজটিও ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী।
গ্রামের প্রবীণজন নজরুল শেখ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মেলা থেকে আগে লেইস ফিতা, আলতা, সুগন্ধি তেল, পাটের তৈরি শিকি (শিকে) কিনতাম। সময় বদলেছে, তার পরও মেলায় আসি। কবির স্পর্শ অনেক আনন্দের।’
মধুসূদন একাডেমির পরিচালক কবি ও মধুসূদন গবেষক খসরু পারভেজ বলেন, ‘আশির দশক থেকে মধুমেলা চলছে। প্রথম দিকে মেলায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা ও কুটির শিল্পের পসরা বসত। মেলার ব্যাপ্তি বাড়ায় সাহিত্যবিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি বর্তমানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ মেলা প্রাঙ্গণে বিভিন্ন দোকানপাটের পসরা বসে।’
মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে এলাকাবাসী গর্বিত। এই উদযাপন ও মেলা তারা ধরে রাখতে চান।