ঢাকা ১৪ চৈত্র ১৪৩১, শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫
English
শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৪ চৈত্র ১৪৩১

বাংলা একাডেমির গঠনতন্ত্র খুলে দেখুন: জাকির তালুকদার

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৩ পিএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম
বাংলা একাডেমির গঠনতন্ত্র খুলে দেখুন: জাকির তালুকদার
কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার ও তার ফেসবুক পোস্ট

বাংলা একাডেমির গঠনতন্ত্র খুলে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে তার ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে লেখকদের প্রতি এ আহ্বান জানান তিনি।

ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘লেখকদের প্রতি গত দশ বছর ধরে অনুরোধ জানিয়ে আসছি। বাংলা একাডেমির দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান। কেউ চিৎকার করেন পুরস্কার নিয়ে, কেউ করেন বইমেলা নিয়ে, কেউ অনুষ্ঠান আর আলোচনা সভার মান নিয়ে, কেউ করেন বাংলা একাডেমি কার কার বই প্রকাশ করল তা নিয়ে।

সব সমস্যার সমাধান আছে একটি সিন্দুকে। সেই সিন্দুকের তালা ভেঙে বাংলা একাডেমির গঠনতন্ত্র বের করে আনুন। ইচ্ছামতো মহাপরিচালক, সভাপতি, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বানানোর অসুস্থ আমলাতান্ত্রিক নোংরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বন্ধে বাংলা একাডেমি, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং সরকারকে বাধ্য করুন। 

কামাল চৌধুরী নূরুল হুদাকে মহাপরিচালক বানাবেন, আসিফ নজরুল মোহাম্মদ আজমকে বানাবেন। ইয়ার্কি পাইছেন? সদস্য, জীবন সদস্য, ফেলোদের মতামতের তোয়াক্কা করবেন না! তোয়াক্কা করবেন না সভাপতি বানানোর ক্ষেত্রেও! 

কার্যনির্বাহী কমিটি আমলাদের দিয়ে ভরে রাখার অধিকার কে দিয়েছে আপনাদের? একজন কুমির ছানা রাখেন দেখানোর জন্য। কখনো রুবি রহমান, কখনো সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, এখন সাজ্জাদ শরিফ। যেহেতু আমলারা লেখক চেনে না, সেই সুযোগ এবার পুরোমাত্রায় কাজে লাগিয়েছেন সাজ্জাদ শরিফ। অথচ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী পরিষদে লেখক সদস্য থাকার কথা ছয়জন। চারজন সাধারণ ও জীবন সদস্যদের মধ্য থেকে, আর দুইজন ফেলোদের মধ্য থেকে। 

একাডেমির প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পয়সা বরাদ্দের অনুমোদন নিতে হবে কার্যনির্বাহী পরিষদের কাছ থেকে।

এসব কি আদৌ জানেন আমাদের দেশের লেখকরা? যারা নাকি এদেশের সবচেয়ে সচেতন অংশ? 

জানার কোনো লক্ষণ তো দেখি না। জানলে অন্ধের হস্তিদর্শনের মতো পা, লেজ, কান নিয়ে টানাটানি করতেন না। যদি সদিচ্ছা থাকে তাহলে বাংলা একাডেমিকে সত্যিকারের বাংলা একাডেমির রূপে ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নামুন।’

অমিয়/

সন্জীদা খাতুন জেগে থাকবেন বহু মানুষের অন্তরে

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ১১:০৮ এএম
সন্জীদা খাতুন জেগে থাকবেন বহু মানুষের অন্তরে
সন্জীদা খাতুন

সন্জীদা খাতুন বাংলার গৌরব। আজীবনের সাধনা দিয়ে তিনি তা অর্জন করেছেন। এই ছায়ানট গড়তে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তিল তিল করে শ্রম দিয়েছেন। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। তিনি নিজের দিকে তাকাননি। পরিবারের দিকে তাকাননি। নিজে ঢুকে গেছেন ছায়ানটে। আজ ছায়ানট কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি প্রতীক, একটি প্রয়াস, একটি জীবনদর্শন। তার সঙ্গে শিল্প আর সংস্কৃতির মিশ্রণ। 

সমাজ জীবনে কত দীর্ঘ পথ তিনি অতিক্রম করেছেন। আর এ অভিযাত্রায় নিজেকে ক্রমে ক্রমে আরও বিকশিত করে তুলেছেন, আরও প্রসারিত করেছেন। আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন। তার সংগীত প্রশিক্ষণ ছিল একটি বড় ক্ষেত্র। পাশাপাশি সংগীতের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, সংগীতের মধ্যে জীবনের যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তার বিশদীকরণ- এই সবকিছুর ক্ষেত্রে সমগ্র বাংলা সংস্কৃতিতে তিনি একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নিজেকে তিনি সর্বত্র গুটিয়ে চলেছেন। আত্ম-অহমিকা বলে তার ভেতর কোনোদিন কিছু ছিল না। তিনি শুধু চেয়েছেন অপরের মধ্যে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে। সে লক্ষ্য নিয়ে তিনি কত রকম কাজে যে যুক্ত হয়েছিলেন। ছায়ানট ঘিরে তার কত রকম কর্মকাণ্ড ছিল। জাতির যেকোনো দুর্যোগে ছায়ানট যেন ঝাঁপ দিতে পারে- সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক, বন্যা-ঝড়-ঝঞ্ঝা হোক বা মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ হোক, সেই চেষ্টা করে গেছেন। যে দুর্যোগ সমাজকে বিভক্ত করে, যে দুর্যোগ সাম্প্রদায়িকতার বিষে সমাজ-দেহকে জর্জরিত করতে চায়, সেই বিষ-বিদ্বেষ অন্তর থেকে দূর করার জন্য নানা রকম সাধনা করেছেন। ব্রতচারী চর্চার কথা যদি বলি, আবৃত্তি চর্চার কথা যদি বলি বা আরও নানা দিক সেসব মিলে তার যে সমগ্রতা সেটা বহুভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ছায়ানট তো একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। কিন্তু এর অন্তরাত্মা ছিলেন সন্জীদা খাতুন। আর এ অন্তরাত্মার যে শক্তি সেটা তিনি প্রতিনিয়ত নানাভাবে প্রকাশ করে গেছেন, বহু মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গেছেন। বহু শিক্ষার্থীর মনে মানবতার দীক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতার দীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সংকটে-দুর্যোগে কীভাবে স্থিতধি থেকে কীভাবে পথ চলতে হয়, সেই প্রেরণা তিনি সঞ্চার করে গেছেন। 

আজকে এই ভবনে তিনি আবার এসেছেন। ‘সম্মুখে শান্তি পারাবার’- তার তরণী তিনি ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আমাদের কর্ণধার। এই ভবনে যখন তার পদপাঠ ঘটে, তখন তার পেছনে দেখি দীর্ঘ ইতিহাস। সেই ষাটের দশকে বাংলা একাডেমির একটা ছোট কক্ষে ছায়ানটের যাত্রা শুরু, তারপর ইংলিশ প্রিপারেটরি স্কুলে ছনে ছাওয়া বেতের ঘর, তারপর নানা জায়গা থেকে বিতাড়িত হতে হতে ছায়ানট স্বাধীনতার পর ঠাঁই পেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে। আর সেখান থেকে ছায়ানট চলে এল তার স্থায়ী ভবনে। এই দীর্ঘ অভিযাত্রায় তিনি যাদের কাছে সংগীতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, সুর পৌঁছে দিয়েছেন, শিল্পের স্পর্শে যাদের জাগ্রত করেছেন, তারা সবাই মিলে ছায়ানট। তারা যেভাবে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের নানা প্রান্তে, দেশের বাইরে সেটাই ছায়ানট। তার বাইরে আরও বড় পরিসরে যে কাজ জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদকে ঘিরে তিনি দেশব্যাপী ঘুরেছেন, চারণের মতো ঘুরেছেন। যেখানে যেটুকু সুযোগ হয়েছে ছেলেমেয়েদের একত্র করে গানের পাঠ দিয়েছেন। এই পাঠ আসলে জীবনের পাঠ। এই তার অবদান, এই তার ভূমিকা, এই তার হাতের স্পর্শ, এই তার কণ্ঠের জাদুস্পর্শ। এই জাদুকাঠির ছোঁয়ায় বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিল। এই জাগরণ ষাটের দশক থেকে ক্রমে ক্রমে পহেলা বৈশাখের আয়োজন। এই ছোট্ট আয়োজন যে বিশাল জাতীয় উদ্যোগে রূপ নিল তার পেছনে ছিলেন সন্জীদা খাতুন। সমস্ত কাজের পেছনে সন্জীদা খাতুন। প্রকাশ্যে তিনি যত না, তার চেয়ে প্রচ্ছনে আগুন জ্বালানোর কাজ করেছেন। এক আগুন থেকে লক্ষ অগ্নিশিখা জ্বালিয়েছেন। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা গড়ে; যারা শিক্ষার্থী-শিল্পী তাদের সঙ্গে লোকসংগীতশিল্পীদের সমন্বয় ঘটিয়ে এক অসাধারণ সাংগীতিক প্রতিবাদের ইতিহাস তিনি রচনা করেছিলেন। আর তারপর বাংলাদেশের যে অভিযাত্রা, সেখানে তিনি চেয়েছিলেন আমরা যেন আরও গভীরে যেতে পারি। আরও যেন ব্যাপ্তি আমরা অর্জন করতে পারি। সে জন্য তিনি নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ছায়ানটের সঙ্গে সমাজের, সংস্কৃতির অসাধারণ মেলবন্ধন তৈরি করেছেন। 

বহু মানুষের অন্তরে তিনি জেগে আছেন। তিনি জেগে থাকবেন দেশের নানা প্রান্তে। যখন নানাভাবে আবারও সেই পুরোনো সাম্প্রদায়িকতা, পুরোনো ঘৃণা-বিদ্বেষ সমাজদেহে নানা বিকৃতি তৈরির প্রয়াস চলছিল, তখন শিল্প ও সংস্কৃতির জোরে জীবন উপলব্ধির শক্তিতে সন্জীদা খাতুন দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের তরণীর কান্ডারি হয়ে উঠেছিলেন। তার সেই ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। তিনি থাকবেন না। তার কর্মের সুফলগুলো রয়ে গেছে। তার কর্ম যাদের উজ্জ্বীবিত করেছে, সেই মানুষগুলো রয়ে গেছে। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে তার জীবন, তার কর্ম, তার সাধনা, তার এই ঐকান্তিক শ্রম, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে তার যে বিনিময় এই সবকিছু মিলিয়েই তার বিশাল ব্যক্তিত্ব। বিগত দশকজুড়ে তিনি নজরুল চর্চায় পরিপূর্ণভাবে নিবেদন করেছিলেন। বাঙালির যে সম্পদ তিনি নিজে আহরণ করেছিলেন, সেই সম্পদ তিনি ক্রমেই প্রসারিত করতে কাজ করে গেছেন। এই কাজ আমাদের জন্য উদাহরণ। এ কাজের মধ্য দিয়ে আমরা সন্জীদা খাতুনকে বারবার ফিরে পাব।

গবেষক-প্রাবন্ধিক, সহসভাপতি, ছায়ানট 

লাইসা আহমদ লিসা 
সাধারণ সম্পাদক, ছায়ানট 
অনেকে সন্জীদা খাতুনকে খুব কঠিন মানুষ মনে করে। অথচ তাকে খুশি করা কিন্তু কঠিন কিছু ছিল না। তার বাইরের দিকটা ডিমের খোলসের মতো, আর ভেতরটা ছিল নরম তুলতুলে। আমি পুত্রবধূ হিসেবে বলব, শাশুড়ির পরিবর্তে তার কাছ থেকে মায়ের ভালোবাসাটাই পেয়েছি। ভেতর ভেতরে প্রচণ্ড স্নেহপ্রবণ মন ছিল তার। ভালো লাগা, মন্দ লাগার ব্যাপারগুলো তিনি স্পষ্ট করে বলে দিতে পারতেন। মনে যা এসেছে, তা তিনি সহজে বলে দিয়েছেন। ন্যায্য কথা তিনি সোজাসাপ্টা বলে দিতেন। তার দৃঢ়তার পরিচয় আমি বহুবার পেয়েছি। কে কোথাকার লোক, তাদের ইতিহাস কী তা নিয়ে জানতেন তিনি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মানুষ সম্পর্কে বলতে পারতেন তিনি। 

আমরা যখন কোনো সংকটে পড়েছি, তার দিকনির্দেশনা পেয়েছি। তাকে জিজ্ঞেস করলেই হতো। আমরা কোন পথে চলব, তার নির্দেশনা দিতেন তিনি। আপসহীন এই মানুষটি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে ছিলেন দৃঢ়চেতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা তার সেই সংগ্রামী রূপটি দেখেছি। ব্যক্তিজীবনের সুখের দিকে না তাকিয়ে সমাজের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে গেছেন। মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। আজীবন সে কাজেই তার দায়বদ্ধতা ছিল। তার সেই দেশপ্রেম জেগে থাকবে আমাদের মনে। 

জ্যোতির্ময় এক পৃথিবী সৃষ্টি করে গেছেন সন্জীদা খাতুন

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ১০:২৬ এএম
আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ১১:০২ এএম
জ্যোতির্ময় এক পৃথিবী সৃষ্টি করে গেছেন সন্জীদা খাতুন
সন্জীদা খাতুন

বাংলাদেশের হৃদয় হতে ঘটেছিল তার উন্মেষ। সেই উন্মেষ ছিল এতটাই অপরূপ যে, জ্যোতির্ময় এক পৃথিবী সৃষ্টি করে গেছেন তিনি। সেই পৃথিবী পরবর্তী প্রজন্মের নিজেদের আত্মপরিচয় আর জাতিসত্তাকে আবিষ্কার করবার পৃথিবী। সংস্কৃতিচর্চার সূত্রে তিনি আমাদের শেকড় আর জাতিগত পরিচয়কে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন। আমরা চিনেছি আমাদের। জেনেছি আমাদের মাতৃভূমিকে। আর এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে স্বাধীন স্বতন্ত্র আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সন্জীদা খাতুনের সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল, তাই একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক। ‘ছায়ানট’-এর সূত্রে সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সচেতন করে তুলেছেন। 

মননচর্চাতেও সন্জীদা খাতুন ছিলেন নিরলস। তিনিই প্রথম শৈল্পিক অনুভব আর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে সমন্বিত করে আমাদের জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তার এই ব্যক্তিগত ভাবনারই রূপায়ণ ঘটেছিল ছায়ানটে। ছায়ানটই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যা আমাদের জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সন্জীদা খাতুনের ভূমিকা তাই অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এভাবে জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। নিজের জীবনকে করে তুলেছেন মহিমান্বিত। মানবতার পাঠ আমরা পেয়েছি তার কাছ থেকে। কাকতাল বলব কি না জানি না, চলেও গেলেন এমন একটা দিনে, যে দিনটিতে পাকিস্তানি শাসকরা মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরোধী ছিলেন তিনি। কী অবিস্মরণীয় সংযোগ! 

সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালে, ব্রিটিশ ভারতে। নিজেই জানিয়েছিলেন, ১৪ বছর বয়সে ইংরেজ শাসনের হাত থেকে মুক্তির উল্লাস তিনি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। লক্ষ করেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষের ভাব। তারপর দিনে দিনে সে স্বাধীনতার স্বরূপ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। প্রথম আক্রমণটা ঘটল ভাষার ওপরে। একুশের শহিদের রক্ত প্রবলভাবে আলোড়িত করল বাংলার মানুষকে। ক্রমে তিনি বুঝেছিলেন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিপর্যস্ত করে বাঙালি পরিচয়কে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভুলিয়ে দিতে চায়। প্রধান করে তুলতে চায় ‘পাকিস্তানি মুসলমান’ পরিচয়কে। ভাষার ওপর আক্রমণের পর তারা যখন এই নীল নকশা নিয়ে এগুতে থাকে, তখনই সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলে বাঙালি পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসতে থাকেন সন্‌জীদা খাতুন ও তার সতীর্থরা। সবাই মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ছায়ানট’। শুরু হলো বাঙালি সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখবার প্রস্তুতি। এরই প্রকাশ ঘটল নববর্ষ পালনের বিশেষ আয়োজনে। সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, বাঙালির সংস্কৃতিজীবনকে ঋদ্ধ করে বাঙালিত্বের দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলবার সাধনা ছিল ‘ছায়ানট’-এর। 

বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি আত্মপরিচয়ের দিক; অন্যটি জাতিসত্তার দিক। আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান থেকেই জাতিসত্তাকে খুঁজে পেয়েছেন এ দেশের মানুষ। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বাংলার মানুষ যখন প্রথম নির্যাতনের শিকার হন, তখনই তাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে বাংলাদেশের বাঙালিদের প্রকৃত পরিচয়টা কী? এই প্রশ্নটা জেগেছিল লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, অর্থাৎ এ দেশের সবচেয়ে সচেতন শ্রেণির মধ্যে। তারা বুঝেছিলেন তাদের প্রথম পরিচয় তারা বাঙালি। তাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু শুধু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকরা যখন ‘পাকিস্তানি’ পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসতে চাইল, তখনই শুরু হলো সাংস্কৃতিক সংঘাত। এ দেশের মানুষ বাঙালি সংস্কৃতিকে সামনে নিয়ে এল আর এতে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘ছায়ানট’, যার পুরোভাগে ছিলেন সন্জীদা খাতুন। বাঙালির স্বাতন্ত্র্য আর সাংস্কৃতিক স্বাধিকার বোধই যে আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তার ভিত্তি, ছায়ানট তা বুঝিয়ে দেয়। এভাবেই সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনতা অভিযাত্রার পটভূমি নির্মাণ করে দিয়েছে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণার দিকে ক্রমেই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই ধারণা নির্মাণে রাজনীতিরও প্রবল ভূমিকা ছিল। পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের শোষণ করছে, বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রয়োজন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার মধ্য দিয়ে সেটি তুলে ধরেন। পাশাপাশি ‘ছায়ানট’ যে ভূমিকা পালন করে, সেটি ছিল এ দেশের মানুষের ‘বাঙালি’ সাংস্কৃতিক পরিচয় বিনির্মাণের।

প্রথম উদ্যোগ হিসেবে ‘ছায়ানট’ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী পালন করেছে। এর পর পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে প্রতিরোধ এলে ১৯৬৭ সালে রমনা বটমূলের পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে। এ দেশের মানুষের মূল পরিচয়টা যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর নির্ভরশীল, ‘ছায়ানট’ সেদিকেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই সংস্কৃতির উৎস হচ্ছে মাটি ও মানুষ। ফলে ‘ছায়ানটে’র অনুষ্ঠান সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্তায় উদ্ধুব্ধ হতে থাকে। 

বাঙালি জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থিদের বিপুল অবদান ছিল। এখন আমরা সেটা ভুলেই গেছি। ষাটের দশকেই এই আন্দোলনটা দানা বেঁধেছিল। কিন্তু সেটা প্রথমে, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী ভাবনার উন্মেষ ঘটে সংস্কৃতির হাত ধরে। এই সাংস্কৃতিক জাগরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল ‘ছায়ানট’। সংস্কৃতি যে রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়, ‘ছায়ানট’ই সেটা বুঝিয়ে দেয়। রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন যে গুরুত্বপূর্ণ, সংস্কৃতিই যে জাতিসত্তার ভিত্তি, এমনকি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিরও উৎস, ‘ছায়ানটে’র মধ্য দিয়েই এ দেশের মানুষ সেটা উপলব্ধি করেছেন।

সন্জীদা খাতুন ছিলেন পুরোপুরি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। নিজেই বলেছেন, রাজনীতির প্রতি তার কোনো আগ্রহ ছিল না, রাজনীতি করেনওনি। কিন্তু তিনি আজীবন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করে গেছেন, তা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তাকে উপলব্ধি করবার মননশীলতায় উদ্ধুদ্ধ করেছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তার অবদান স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবে।

পরিণত বয়সেই তিনি চলে গেলেন, কিন্তু কোনো কোনো মৃত্যুর ক্ষতি এতটাই অপূরণীয় যে, সেই মৃত্যুর কোনো প্রতিস্থাপন হয় না। সন্জীদা খাতুন তেমনই একজন চিরপ্রণম্য মানুষ। জীবনানন্দ দাশের সেই কথাটা দিয়ে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি, ‘মহৎ মানুষের মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়…।’

গানে গানে বিদায় কিংবদন্তিকে সন্জীদা খাতুনকে

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৬ এএম
গানে গানে বিদায় কিংবদন্তিকে সন্জীদা খাতুনকে
গানে গানে বিদায় দিচ্ছেন সন্জীদা খাতুনকে। ছবি: খবরের কাগজ

ঘড়ির কাঁটায় তখন বুধবার বেলা সাড়ে ১২টা। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনের কোথাও নেই তিল ধারণের ঠাঁই। অগ্রগণ্য শিল্পীরা গাইছেন ‘তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে’, ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’সহ রবিঠাকুরের একগুচ্ছ গান। কদিন আগেও ছায়ানটের আসরগুলোতে যে গান আনন্দের ফোয়ারা বইয়ে দিত, সেই গানগুলোই কত বিমর্ষ শোনাল চৈত্রদুপুরে। কারণ সেই আসরের মধ্যমণি সন্জীদা খাতুনের নিথর মরদেহ আনা হয়েছে ছায়ানট প্রাঙ্গণে। কদিন পরেই বাংলা নববর্ষ। তারই প্রস্তুতি হচ্ছিল ছায়ানট প্রাঙ্গণে। এমন সময় শান্তি পারাবারে তর‌ণী ভাসালেন সন্জীদা খাতুন; সবার প্রিয় ‘মিনু আপা’। 

স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘর থেকে সন্জীদা খাতুনের লাশ যখন ছায়ানটে নিয়ে আসা হলো, তখন মধ্যদুপুর। সংস্কৃতি অঙ্গনের মহারথীদের পাশাপাশি তরুণ সংস্কৃতিকর্মীরাও চোখভরা জল নিয়ে হাজির ছায়ানট প্রাঙ্গণে। শেষবার ‘প্রিয় মিনু আপা’কে দেখবেন বলে দূরের জেলা থেকে ছুটে আসে খুদে শিল্পীরাও। 

ছায়ানট প্রাঙ্গণে কথা হয় সন্জীদা খাতুনের নাতনি সায়ন্তনী তিশার সঙ্গে। গত সপ্তাহে সন্জীদা খাতুনকে যখন স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, এইচডিইউ ইউনিটের শয্যায় শুয়ে ‘প্রিয় নানু’ তাকে কী কথা শুনিয়েছেন তাই শোনালেন তিনি। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে গেছেন নাতনিকে। সন্জীদা খাতুন বলেছিলেন, ‘আমার অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছি না। বাংলাদেশটা তো এমন ছিল না। কী হয়ে গেল?’ তখন তাকে শান্ত করতে তিশা কোনো প্রিয় গানের কথা স্মরণ করতে বলেন। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারই দলে...’ গানটির কথা মনে করেন সন্জীদা খাতুন। তিশার কথা শেষ হতেই সাউন্ড বক্সে বেজে ওঠে সন্জীদা খাতুনের কণ্ঠ, তিনি গাইছেন ‘ঝরা পাতা গো’। এই গানে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে আসে ছায়ানট ভবনে। শোকার্ত কাফেলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ততক্ষণে গোলাপ, বেলিসহ নানা রঙের ফুলে ঢেকে যায় কফিন। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম তখন দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন সব আয়োজন। 

সাবেক সংসদ সদস্য ও শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্ত বলেন, ‘সন্জীদা খাতুন বাঙালি সংস্কৃতির জন্য আজন্ম কাজ করেছেন। তিনি সারা পৃথিবীতেই বাঙালিকে উঁচু স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পথ ধরে তিনি আলো বিলিয়েছেন। সেই আলোয় আমরা আলোকিত হয়েছি।’ রামেন্দু মজুমদার বলেন, ‘সন্জীদা খাতুন এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। শুদ্ধ সংগীতের প্রসারে সারা দেশে কাজ করেছেন। অসংখ্য মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেছেন। যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা আলোকিত হয়েছেন।’ নাট্যজন ম. হামিদ বলেন, ‘সংস্কৃতি আশ্রয়ে সন্জীদা খাতুন মানবিকতার বিকাশ ঘটিয়ে মূল্যবোধ জাগ্রত করার দীক্ষা দিয়েছেন; শিখিয়েছেন দেশ ও নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত বাঙালি হওয়া শিখিয়েছেন।’ অভিনেতা তারিক আনাম খান বলেন, ‘সন্জীদা খাতুনকে অনুসরণ করেই আমরা শিল্প-সংস্কৃতির পথ চিনেছি। শিল্পকে নিছক বিনোদনের বাইরে সমাজ পরিবর্তনের দর্শন হিসেবে ভাবতে শিখেছি। শিল্পের আলোয় সত্য ও ন্যায়ের পথ চিনেছি। এ কারণেই তিনি এ দেশের সংস্কৃতি ভুবনের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব।’ 

দুপুর ১টার দিকে সন্জীদা খাতুনের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের বাংলা বিভাগে। তিনি এই বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। এখানে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক সৈয়দ আজিজুল হক, আখতার কামাল, কবি দিলারা হাফিজ। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘পরিপূর্ণ এক সফল জীবনকে আলিঙ্গন করেছেন সন্জীদা খাতুন।’ সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণে তার ভূমিকা অনন্য। বাংলাদেশের প্রগতি ধারা নির্মাণ করে তিনি নিজেকে এক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনিই যে আমাদের মহীরূহ।’

পরে বুধবার বেলা আড়াইটায় লাশ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। এখানে নাগরিকদের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের কাজটি তত্ত্বাবধান করেন খ্যাতিমান অভিনেতা ঝুনা চৌধুরী, গণসংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট ও আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলাম। এ পর্বে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, নৃত্যাঞ্চল, মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্ট। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সিপিবি ও ঐক্য ন্যাপ নেতারা শ্রদ্ধা জানান। 

সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, ‘সন্জীদা খাতুনের মতো মানুষের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক জানানো না হলে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। রাষ্ট্র তাকে মনে না রাখলেও তিনি বেঁচে থাকবেন এ দেশের মানুষের হৃদয়ে। বেঁচে থাকবেন আপন কাজ ও দর্শনের মাঝে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারপারসন তামান্না রহমান বলেন, ‘মিনু আপার দুটি গুণের কথা বলব। একটি তার সাংগঠনিক দক্ষতা, অন্যটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অবিচল থাকা, তার দৃঢ়তা। এ গুণ দুটি তিনি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে গেছেন।’

সন্জীদা খাতুনের পুত্রবধূ ও ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, বুধবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সন্জীদা খাতুনের লাশ রাখা হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মরচুয়ারিতে। তার লাশ কোথায় দাফন করা হবে, এ বিষয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে ছায়ানট জানাবে দেশবাসীকে।

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৪:১৩ পিএম
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...
সন্জীদা খাতুন

সর্বান্তঃকরণে বঙ্গজ সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে শুদ্ধ বাঙালি হওয়ার ব্রত নিয়ে বন্ধুর পথে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। কৈশোরে দেখেছেন পাকিস্তানের সামরিক শাসন। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙবে বলে তখন বাঙালির ধনুকভাঙা পণ। সেই স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করতে সন্জীদা খাতুন কণ্ঠে তুলে নিলেন গান। তার কণ্ঠে দেশমাতৃকার গান অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে একাত্তরের রণাঙ্গনে। 

সন্জীদা খাতুন থেমে থাকেননি। সর্বান্তকরণে বাঙালি হওয়ার ব্রত নিয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে হেঁটে বেড়িয়েছেন গানের ডালি নিয়ে। কথা-তাল-সুরে অন্তরের শুভবোধকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। বাংলা সংস্কৃতির ধারাকে রুখে দিতে যত প্রতিবন্ধকতা এসেছে, তার বিপরীতে সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো তিনিও বারবার বলেছেন, ‘আমার এই পথ চলাতে আনন্দ’। ঝঞ্ঝা আসুক কিংবা হঠাৎ দুর্বিপাক, সংস্কৃতিজনদের নিয়ে সন্জীদা খাতুন লড়াই করেছেন অবিরাম। বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ‘ছায়ানট’-এর সমার্থকই যেন হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় ‘মিনু আপা’। সংস্কৃতিজনের ভাষ্যে, তাদের ‘মিনু আপা’ এক মহীরুহ; দেশ ও মাটির প্রতি টান যাকে নিয়ে গেছে অনতিক্রম্য উচ্চতায়। 

বিধাতার নিয়মানুসারে সবাইকে একদিন থামতে হয়। মহাকাল যতিচিহ্ন এঁকে দেয় আয়ুরেখায়। সন্জীদা খাতুনকেও থামতে হলো। ৯২ বছর বয়সে থেমে গেল তার পথচলা। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ছায়ানটের এই সভাপতি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার পুত্রবধূ ও ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় সন্জীদা খাতুনের লাশ ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে আনা হবে। তার মৃত্যুতে দেশের সংস্কৃত অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
এক জীবনে সন্জীদা খাতুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে ড. সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন তিনি।

সন্‌জীদা খাতুন রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসংগীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’। রবীন্দ্র বিষয়ক তার সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’। একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সংগীতজ্ঞ এবং শিক্ষক সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্র চর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রসারে অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো সন্জীদা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী প্রবর্তিত দেশিকোত্তম সম্মাননায় ভূষিত হন। ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যখন উত্তুঙ্গে, সন্জীদা খাতুন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেকে নিহত হন। পরের দিন পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনে নারীদের এক প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তৃতা করেন সনজীদা। তিনি বলেছিলেন, ‘একুশ আমাকে ভাষা দিয়েছে।’

বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে কবি সুফিয়া কামাল, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক আর সংস্কৃতি-সংগঠক আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সংস্কৃতি-অঙ্গন ছায়ানট। ছায়ানটের প্রথম কমিটিতে যুক্ত হন সন্জীদা খাতুন। সে সময় তিনি শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে ব্রতচারী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। 

অর্ধশতাব্দীকালের নিরলস সাধনায় বাংলা নববর্ষ উৎসবকে তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়েছেন। ২০০১ সালে রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের উৎসবে বোমা-হামলার পরেও ছায়ানট থেমে থাকেনি। সংস্কৃতিজনদের ভাষ্যে, ‘মিনু আপার অমিত সাহসেই ছায়ানট ভীত না হয়ে এগিয়ে গেছে।’ অশুভর বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম ছিল সন্জীদা খাতুনের। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সুরকে হাতিয়ার করে সম্প্রীতির বন্ধনে তিনি বাঁধতে চেয়েছেন মানুষকে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে সন্জীদা খাতুন ব্রতী হয়েছিলেন শুদ্ধ মানুষ গড়ার সংগ্রামে। সেই কাজটি করতে পেরেছেন বলে জীবনকে অর্থবহ মনে করেছেন তিনি। ২০২৩ সালে নিজের ৯১তম জন্মদিনের আয়োজনে তিনি বলেছেন, ‘সেই- যে ছেলেবেলায় সবার মঙ্গলসাধনের ইচ্ছা, তা পূর্ণ হতে পেরেছে এইভাবে। শিশুদের জন্য, দেশের জন্য বাঙালি জাতির জন্য কাজ করে আমার জীবনটা অর্থবহ হয়েছে বলে মনে করি। অল্পে তুষ্ট সহজ-সরল জীবনের এই সার্থকতায় আমি ধন্য হয়েছি।’ নবতিপূর্ণা সন্জীদা খাতুন ছায়ানটের সেই আসরে গাইলেন তার শৈশবে শেখা প্রিয় গান ‘তৃষ্ণার জল এসো এসো হে’।

সেই সর্বশেষ জনসমক্ষে আসেন সবার প্রিয় ‘মিনু আপা’। বার্ধক্যজনিত নানা অসুখের পাশাপাশি তিনি কিডনির সংক্রমণে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। 
ড. সন্‌জীদা খাতুনের জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সন্‌জীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থে আটটি বিভাগে প্রায় ৬০ জনের লেখায়। সেখানে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, ‘গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে, দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে। আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।’

ড. সন্জীদা খাতুনের প্রয়াণে শোক জানিয়েছে বাংলা একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছে জাতীয় পার্টি, সিপিবি। 

ছায়ানট-শরৎ পাঠচক্র পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণীজন

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০৬ পিএম
আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:৪৫ পিএম
ছায়ানট-শরৎ পাঠচক্র পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণীজন
বাচিকশিল্পী দেবাশিস বসু, কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তী ও বাচিকশিল্পী চন্দ্রিমা রায়

ছায়ানট (কলকাতা) এবং শরৎ পাঠচক্রের যৌথ উদ্যোগে গত বছরের মতো এবারও তিন গুণীজনকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হবে।

বিশ্ব কবিতা দিবস উপলক্ষে আগামী ২৭ মার্চ, বৃহস্পতিবার কলকাতার শরৎচন্দ্র বাসভবনে সন্ধ্যা ৬টায় বিশেষ অনুষ্ঠান ‘কবিতাকে ভালোবেসে’র আয়ােজন করা হয়েছে।

এবার যাদের সম্মাননা দেওয়া হবে তারা হলেন- দুই গুণী বাচিকশিল্পী দেবাশিস বসু ও চন্দ্রিমা রায় এবং বর্তমান সময়ের বিশিষ্ট কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তী।

দেবাশিস বসু একজন জনপ্রিয় প্রিয়জন। কথা কইতে কইতে পাঁচ দশক পার। রেডিও, টিভি, স্টেজ, ফিল্ম, ডকুমেন্টারি, রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি - সবেতেই তাঁর কণ্ঠস্বর। সুজন রসিক বলে ‘কথা তো নয়, যেন গান’। কানের আরাম, প্রাণের আরাম। ভালোবাসতে বড্ড ভালোবাসেন সহজিয়া কথক।

ঋজুরেখ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৬৭ সালের ৬ জুলাই, কলকাতায়। লেখালিখি শুরু আটের দশকের মাঝামাঝি। স্কুল ও কলেজ ম্যাগাজ়িন বাদে প্রথম কবিতা প্রকাশ দেশ পত্রিকায় ১৯৮৬ সালে ১৯ বছর বয়সে। বর্তমানে সল্ট লেকের স্থায়ী বাসিন্দা ঋজুরেখর প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা ১৯। এছাড়া, ‘কবিতাসমগ্র’ প্রথম খণ্ডও প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পথে। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’। তাছাড়া তাঁর পাঁচটি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে।

বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত ঋজুরেখ টানা ৩২ বছর রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আধিকারিক হিসেবে কর্মজীবন অতিবাহিত করার পর সম্প্রতি স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে সাহিত্যচর্চা করছেন।

চন্দ্রিমা রায় মেধা এবং মননের এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তাঁর সমার্থক পরিচয় ‘কবিতায় কথালাপ’। চন্দ্রিমা একাধারে তার কর্ণধার এবং প্রতিষ্ঠাতা আবার অন্যদিকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এর অধ্যাপক। গবেষণা করেছেন চেতনামূলক স্নায়ুবিজ্ঞান (Cognitive neuroscience) নিয়ে। কবিতা আবৃত্তি করেছেন দেশ-বিদেশের বহু মঞ্চে। পেয়েছেন ন্যাশনাল স্কলারশিপ এবং বহু পুরস্কার।

সৌভাগ্যের ঝুলিতে রয়েছে দুজন নোবেল লরিয়েট এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আব্দুল কালামের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ। তাছাড়া তিনি প্রসার ভারতীর সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড এডুকেশেনের ন্যাশনাল করেসপন্ডেন্ট।