
কথায়, গানে ও কবিতায় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে যৌথভাবে স্মরণ করল ‘ছায়ানট’ (কলকাতা) এবং ‘সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার’। অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল ৫ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন, কলকাতা-১২ ঠিকানায় সাহিত্য সম্রাটের নামাঙ্কিত ঐতিহ্যমণ্ডিত গ্রন্থাগার ভবনে। অনুষ্ঠানের বিস্তারিত বিবরণে যাবার আগে অনুষ্ঠানস্থলের ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু বলে নেওয়া যাক।
মধ্য কলকাতায় ৫ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন এবং ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন- একই রাস্তায় সামান্য ব্যবধানে অবস্থিত এই দুটি বাড়িতেই একসময় বাংলা সংস্কৃতির গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয়েছিল। কিছু মানুষ জানলেও, অনেকেরই হয়তো অজানা ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিপরীতে অবস্থিত এই দুটি বাড়ির মাহাত্ম্য। ৫ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের বাড়িটি ছিল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ সাত বছরের আবাসভূমি। আর ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের বাড়িটিতে ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কিছুদিনের আবাস ও ধূমকেতু পত্রিকার অফিস।

আজ থেকে প্রায় ১৩৪ বছর আগে যখন বঙ্কিমচন্দ্র হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন অর্থাৎ ১৮৮৭ সালে জানুয়ারি মাসে এই বাড়িটি সম্ভবত দুর্গাপ্রসন্ন ঘোষের কাছ থেকে কেনেন এবং জীবনের শেষ সাত বছর এখানে সপরিবারে ছিলেন। এই বাড়িতে বসেই তিনি ‘সীতারাম’ (১৮৮৭), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮৭), ‘ধর্মতত্ত্ব প্রথম ভাগ অনুশীলন’ (১৮৮৮), ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৮৯২) প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন ‘প্রচার’ পত্রিকা। এ ছাড়া এখান থেকেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের রচনাসংগ্রহ সম্পাদনা করতেন। পরামর্শ দিতেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম বিষয়ে। এভাবেই তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কর্মব্যস্ত ছিলেন এবং তার ফলে ওই সময়টা নক্ষত্র সমাবেশে আলোকিত হয়ে থাকত এই বাড়ি, এই পাড়া। সেই নক্ষত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বর্ণকুমারী দেবী, সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতি, আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ।
অপরদিকে ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের বাড়িটিতে পার্টিশন করে একদিকে ছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মেস। অন্যদিকে ধূমকেতু পত্রিকার অফিস। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘নজরুল স্মৃতি’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বেশ আড্ডা জমতো ধূমকেতুর অফিসে। থাকতেন স্বয়ং নজরুল। তাঁর তো ওটাই বাসস্থান ছিল। এ ছাড়া আসতেন মুজফ্ফর আহ্মদ, মানবেন্দ্রনাথ রায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, ভূপতি মজুমদার প্রমুখ। আড্ডার সঙ্গে মুহুর্মুহু চায়ের ভাঁড় ঘুরতো অফিসের এদিক থেকে ওদিক। ক্রাউন ফোলিও সাইজের আট পৃষ্ঠার অর্ধ-সাপ্তাহিক কাগজ নিয়ম করে বেরতো। দাম ছিল এক আনা। গ্রাহকদের জন্য বছরে পাঁচ টাকা। কিন্তু কী ঝাঁঝ, কী বিপ্লবীয়ানা ছিল এই পত্রিকার। শুরু থেকেই গোটা বাংলা উজ্জীবিত তার দাপটে। বিশেষ করে তখনকার তরুণ শিক্ষিত সমাজ। ব্রিটিশদের কাছে এটাই ছিল উদ্বেগের। তাই সর্বক্ষণ তাদের নজর থাকত ওই বাড়িটির প্রতি।’

তবে ‘ধূমকেতু’র আয়ু বেশিদিন ছিল না। হঠাৎই আসা আর হঠাৎ ধূমকেতুর মতো মিলিয়ে যাওয়া। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট থেকে ১৯২৩-এর মার্চ। মাত্র সাত মাস চলেছিল। শুধু প্রথম মাস ধূমকেতুর অফিস ছিল ৩২ কলেজ স্ট্রিট। কিন্তু কাগজের এরকম আগুনে মেজাজ দেখে বাড়িওয়ালা পুলিশের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তাদের বাড়ি থেকে তুলে দিল। তারপর থেকেই ধূমকেতুর ঠিকানা এই ৭ নম্বর প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন। তখনকার দিনে কাগজটি বিপ্লবীদের হাতিয়ার ছিল বলা যায়। সমর্থন ছিল বুদ্ধিজীবী মহলেরও। রবীন্দ্রনাথ তো ধূমকেতুকে আশীর্বাদ করে লিখেই ফেললেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু …’।
১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর সংখ্যায় নজরুল লিখলেন, ‘স্বরাজ-টরাজ বুঝিনা, কেননা ওই কথার মানে এক একজন মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীনে থাকবে না …।’ এতেই ভয় পেয়ে গেল ইংরেজ সরকার। তারা বুঝেছিল এই পত্রিকা বেশিদিন থাকলে তাদের বিপদ অনিবার্য। তারা সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। অবশেষে এল সে সময়, যেদিন ধূমকেতুতে প্রকাশিত হলো নজরুলের আক্রমণাত্মক সেই কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল? স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল’। সঙ্গে সঙ্গে রাজরোষে বন্ধ হলো পত্রিকা। প্রথমে পুলিশ হানা দিল প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনে ধূমকেতুর অফিসে। সম্পাদককে পাওয়া গেল না। তিনি তখন ফেরার। এর কিছুদিন পর অবশ্য তিনি কুমিল্লায় ধরা পড়লেন। বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল তার।
আবার ফিরে আসি ছায়ানট ও বঙ্কিম গ্রন্থাগারের অনুষ্ঠানের কথায়। বঙ্কিমচন্দ্র রচিত বন্দে মাতরম্ গান দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। তারপরে এদিনের অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে দর্শক-শ্রোতাদের অবহিত করেন গ্রন্থাগারের অন্যতম সদস্য তথা সাহিত্যিক গোপাল দাস। অগ্রজ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি নজরুলের যে শ্রদ্ধা- সেই সম্পর্কে আলোকপাত করেন ছায়ানটের কর্ণধার সোমঋতা মল্লিক।
১৯৪১ সালের ২৭ জুন রাত ৯টায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিবার্ষিকী উপলক্ষে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে নজরুল রচিত ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ কথিকাটি সম্প্রচারিত হয়। এই কথিকায় নজরুল সাহিত্য সম্রাটকে তাঁর পরবর্তী সমস্ত কবি, সাহিত্যিকের পিতামহ ব্রহ্মা বলে উল্লেখ করেছেন।
পরবর্তী সময়ে সোমঋতার সুদক্ষ পরিচালনায় ছায়ানটের সদস্যরা সমবেত ও এককভাবে কাজী নজরুলের বিভিন্ন গান এবং কবিতা পরিবেশন করেন। পাশাপাশি আরও কিছু আমন্ত্রিত গুণীজন বঙ্কিমচন্দ্র ও কাজী নজরুলের বিষয়ে আলোচনা, সংগীত ও কবিতা পাঠ করেন।
তাদের মধ্যে ছিলেন অভিনব গুপ্ত, মিঠু চক্রবর্তী, মায়া দাস, সুস্মিতা মুখার্জি, মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন, সাবিনা ইয়াসমিন, দেবযানী বিশ্বাস, সুজল দত্ত, স্নেহাঙ্গনা ভট্টাচার্য্য, জি এম আবু বকর প্রমুখ বিশিষ্টজন।
সীমিত জায়গায় আড়ম্বরহীন আয়োজনে এদিনের অনুষ্ঠান ছিল প্রাণপ্রাচুর্য এবং আন্তরিকতায় ভরা। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন গ্রন্থাগারের সচিব প্রবীর বসু।
বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির দুই মহান ব্যক্তির স্মৃতিবিজড়িত দুটি বাড়িকেই সরকার হেরিটেজ ঘোষণা করে। তার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের মূল বাড়িটি ভগ্নস্তূপে পরিণত হওয়ায় সেই জমিতে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ২০০৪ সালে নির্মিত ও পরিচালিত ‘সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র স্মৃতি গ্রন্থাগার’ সাহিত্য সম্রাটের স্মৃতি বহন করছে।
অপরদিকে কাজী নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত মূল বাড়িটি অর্ধজীর্ণ অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটির নিচতলায় চলছে একটি ছাপাখানা। উপরতলায় এক সময়কার সরগরম ধূমকেতুর কার্যালয় কক্ষটি এখন জনমানবহীন নৈঃশব্দের অন্ধকারে ডুবে আছে। আশা করি সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এই বাড়িটির সংস্কারসাধন এবং রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে আসবে। নাহলে অদূর ভবিষ্যতে এটি বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
সালমান/