ঢাকা ৫ বৈশাখ ১৪৩২, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
English
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

ট্রেইনার নজরুল

প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:০৭ পিএম
আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
ট্রেইনার নজরুল
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগৃহীত একটি ছবি

বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ড. রফিকুল ইসলাম তাঁর নজরুল জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন - ‘নজরুল ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এইচ এম ভি গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গীত রচয়িতা ও ট্রেইনার হিসেবে ছিলেন। ওই সময়কালে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তাঁর গানে অন্য কেউ সুর করতে পারতেন না। নজরুলের প্রশিক্ষণে প্রথম প্রকাশিত ‘নজরুল-সঙ্গীত’-এর রেকর্ডে আঙুরবালার গাওয়া দুটি গান ছিল, ‘ভুলি কেমনে’ ও ‘এত জল ও কাজল’, আরও ছিল নজরুলের কণ্ঠে স্বরচিত আবৃত্তি ‘নারী’ কবিতা এবং কে মল্লিকের গাওয়া ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ এবং ‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায়’।

ওইসব গান ও আবৃত্তির রেকর্ড হয়েছিল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের দিকে আর প্রকাশিত হয়েছিল বছরের শেষ দিকে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে যে ছয়জন শিল্পী এইচ এম ভি থেকে নজরুলের মোট ১০টি গান রেকর্ড করেছিলেন, তাঁরা হলেন- আঙুরবালা, ইন্দুবালা, মানিকমালা, উমাপদ ভট্টাচার্য, কে মল্লিক ও প্রতিভা সোম (বসু)...। এভাবেই এইচ এম ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দিয়ে শিল্পী নজরুল, সঙ্গীত প্রশিক্ষক নজরুলে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।’

বিশিষ্ট নজরুল-সঙ্গীতশিল্পী আঙুরবালা দেবী তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘কাজীদার কাছে গানের ট্রেনিং নেওয়াটা ছিল খেলার মতো, রিহার্সালে বসে সুন্দর আবহাওয়া সৃষ্টি করতেন তিনি। গান করার পর প্রায়ই ঠাট্টা করে একটি কথা বলতেন কাজীদা। হয়তো একটি নতুন গান লিখে সুর বেঁধে শোনালেন। তারপরই তাঁর স্বভাবসুলভ প্রাণখোলা হাসিতে ঘর ভরিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি আমার মতো করে গাইলাম। এবার নানী, তুমি আঙুরের রস মিশিয়ে বেশ মিষ্টি করে গাও দেখি।’

কাজী নজরুল ইসলামকে ট্রেইনার হিসেবে পেয়েছিলেন ইন্দুবালা দেবী। তিনি নজরুলকে ‘সুরের রাজা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবে চমৎকার গান তৈরি করতেন নজরুল, সেই বিষয়েও তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকে আমরা জানতে পারি- ‘কাজীদা এত বড় ছিলেন, এতো মহান ছিলেন, তবুও তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে বন্ধুর মতো আলোচনা করতেন। এমনকি, যে গানের জন্য তাঁর এত খ্যাতি, এত দেশজোড়া নাম, সেই গানের বাণী তৈরির সময়েও তিনি জিজ্ঞেস করতেন আমাদের মতামত। কাজীদার একটি জিনিস দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। শুধু আমি কেন, আমার মতো অনেকেই হতো। রিহার্সাল ঘরে হৈ-হুল্লোড় চলছে, নানাজনে করছেন নানারকম আলোচনা। কাজীদাও সকলের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করছেন, হঠাৎ চুপ করে গেলেন। একধারে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন খানিক। অনেকে তাঁর এই ভাবান্তর লক্ষ্যই করল না হয়তো। কাজীদার সেদিকে খেয়াল নেই। এত গোলমালের মধ্যেও তিনি একটুক্ষণ ভেবে নিয়েই কাগজ-কলম টেনে নিলেন। তারপর খসখস করে লিখে চললেন আপন মনে। মাত্র আধঘণ্টা কি তারও কম সময়ের মধ্যে পাঁচ-ছ’খানি গান লিখে পাঁচ-ছ’জনের হাতে হাতে বিলি করে দিলেন। যেন মাথার মধ্যে তাঁর গানগুলি সাজানোই ছিল, কাগজ-কলম নিয়ে সেগুলো লিখে ফেলতেই যা দেরি। কাজীদা এই রকম ভিড়ের মধ্যে, আর অল্প সময়ের মধ্যে এমন সুন্দর গান লিখতে পারতেন।

আর শুধু কী এই? সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে সেই পাঁচ-ছ’জনকে নতুন গান শিখিয়ে দিয়ে তবে রেহাই দিতেন তিনি। গান লেখার সাথে সাথে সুরও তৈরি করে ফেলতেন কাজীদা। অপূর্ব সব সুর, যার তুলনা হয় না। কাজীদা ছিলেন সুরের রাজা।’

গ্রামোফোন কোম্পানিতে নজরুল কিভাবে গান তৈরি করতেন, তা প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয় কবি জসীম উদ্দীনের। তিনি চমৎকারভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন- ‘গ্রামোফোন-কোম্পানিতে গিয়া বহুদিন কবিকে গান রচনা করিতে দেখিয়াছি। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এঘরে-ওঘরে গায়কেরা নানা রাগ-রাগিনী ভাঁজিয়া সুরাসুরের লড়াই বাধাইয়া তুলিয়াছেন, কানে তালা লাগিবার উপক্রম। মাঝখানে কবি বসিয়া আছেন হারমোনিয়াম সামনে লইয়া। পার্শ্বে অনেকগুলি পান, আর পেয়ালা ভরা গরম চা। ছয়-সাতজন গায়ক-গায়িকা বসিয়া আছেন কবির রচনার প্রতীক্ষায়। একজনের চাই দুইটি শ্যামাসঙ্গীত, অপরের চাই একটি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কীর্তন, একজনের চাই দুইটি ইসলামী সংগীত, অন্যজনের চাই চারিটি ভাটিয়ালী গান, আর একজনের চাই আধুনিক প্রেমের গান। এঁরা যেন অঞ্জলি পাতিয়া বসিয়া আছেন। কবি তাঁহার মানস-লোক হইতে সুধা আহরণ করিয়া আনিয়া তাহাদের করপুট ভরিয়া দিলেন।

কবি ধীরে ধীরে হারমোনিয়াম বাজাইতেছেন, আর গুনগুন করিয়া গানের কথাগুলি গাহিয়া চলিয়াছেন। মাঝে মাঝে থামিয়া কথাগুলি লিখিয়া লইতেছেন। এইভাবে একই অধিবেশনে সাত-আটটি গান শুধু রচিত হইতেছে না - তাহারা সুর সংযোজিত হইয়া উপযুক্ত শিষ্যের কণ্ঠে গিয়া আশ্রয় লইতেছে।’

শিক্ষক হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম কেমন ছিলেন তা জানা যায় বরদা গুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে, ‘‘কাজীদা তাঁর স্বরচিত গানে শুধু সুর যোজনা করেই থেমে থাকেননি, নিজে সেই গান অক্লান্ত পরিশ্রমে শিখিয়েছেন সঙ্গীতশিল্পীদের। গান রচনা ও সুর যোজনা ছাড়া এই শেখানোর কাজে যে সময় তাঁর খরচ হয়েছে, সেই সময়গুলি অন্যত্র অন্যভাবে ব্যবহৃত হলে কাজীদা বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্য ভাণ্ডারে আরও অনেক মূল্যবান রত্ন জমিয়ে রেখে যেতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। কাজীদার এই গান শেখানোর পদ্ধতি আর সংগীত শিক্ষাগুরু হিসেবে তাঁর ব্যবহারটি অনুকরণযোগ্য। অনুকরণযোগ্য এই জন্যে বলছি যে, গান শেখাতে বসে কাজীদা যে অসীম ধৈর্য, অফুরন্ত অধ্যবসায় আর বুক-ভরা ক্ষমা-স্নেহ-মায়া-মমতায় নিজের দরাজ হৃদয়টি ভরিয়ে রাখতেন, তা যদি অন্য সকল শিক্ষকদের পক্ষে রাখা সম্ভব হতো, অনুকরণ করতে পারতেন কাজীদার এই প্রকৃতিটি, তাহলে তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের জড়তা কাটিয়ে উঠতে পারত সহজে, অনেক নির্ভয়ে আর দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে উত্তীর্ণ হতে পারতো। কাজীদা যাকে গান শেখাতেন তাকে বুক ভরা ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতেন। কথায় গানে গল্পে হাসিতে শিক্ষার্থী মনটিকে করে নিতেন খোলামেলা নির্ভয়। শিক্ষার্থীর মনে আত্মবিশ্বাস জাগাতে কাজীদার জুড়ি ছিল না। ‘ওর দ্বারায় এ কাজ হবে না, এ গান ও গাইতে পারবে না’-এ ধরণের কথাকে কোনদিন কোনো সময়েই কাজীদা আমল দেননি। যা সম্ভব নয়, তা তিনি সম্ভব করেছেন! যে যা পারবে না, পারবার কথা নয় - তাকে দিয়ে তাই করিয়ে মনে অটুট আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দিয়েছেন। কোনো শিক্ষার্থী হেয় হয়, মনে দুঃখ পায়, অপমান বোধ করে, এমন ব্যবহার কাজীদাকে কোনদিনই করতে দেখিনি। গান শেখানোর কাজে ছিল তাঁর অসীম ধৈর্য, অফুরন্ত অধ্যবসায়।
একদিন দেখলাম কাজীদা একটি দুরূহ সুরের গান একজন শিক্ষার্থীকে শেখাতে বসেছেন, কিন্তু শিক্ষার্থী সেই ধরনের গান শেখার পক্ষে মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই কাজীদা তাকে বারবার একই লাইন গেয়ে শোনানো সত্বেও সঠিকভাবে সুর আনতে পারছে না। এমনকি, কাজীদার গাওয়া সুরের কাছাকাছিও যেতে পারছে না। এতোবার এতো ভাবে বোঝানো সত্ত্বেও শিক্ষার্থী অকৃতকার্য। 
কাজীদা কি এবার বিরক্ত হলেন? না।
শিক্ষার্থী নিজের অকৃতকার্যতায় যত ভীত হয়, লজ্জিত হয়, অপমান বোধ করে, কাজীদা ততই যেন নিজের প্রাণখোলা হাসি বিলিয়ে দিয়ে তাকে সাহসী করে তোলেন, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। ‘আরে, কি হলো, দেখছো কি? গাও গাও, এ তো খুব সহজ গান। আচ্ছা, আবার একবার আমি গাইছি-শোনো।’
কাজীদা আবার গাইলেন। তারপর গান থামিয়ে শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘কি, হচ্ছে না? আচ্ছা, আমার সঙ্গে সঙ্গে গাও।’
শুরু হলো গান। কাজীদার গলার সঙ্গে গলা মেলালো শিক্ষার্থী। এমন একদিন নয়। বহু দিন বহু জায়গায় বহু পরিবেশে আমি দেখেছি।’’

গান তৈরির সময় কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে শিল্পী যূথিকা রায়ের। তিনি লিখেছেন, ‘অনেক সময় গ্রামোফোন কোম্পানির ঘরে বসে কবির গান লেখা ও সুর তৈরি করার সুন্দর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। কবি যখন তন্ময় হয়ে বসে সুর করতেন বা গান লিখতেন, তখন মনে হতো কোনো সাধক সৃষ্টির আনন্দে, ভাবের ঘোরে কোথায় যেন ডুবে আছেন। সে পরিবেশ ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি নিঃশব্দে সে দৃশ্য দেখে কবির প্রতি আমার প্রণাম জানাতাম।’

একই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন শিল্পীর জন্য নানা ধরণের সঙ্গীত রচনা করতেন অবলীলায়। তার বর্ণনা আমরা পাই অখিল নিয়োগীর লেখায়- ‘যে সময়ের কথা বলছি তখন কাজীদা সংগীত সাগরে নিত্য ভাসমান। প্রত্যহ গ্রামোফোন রিহার্সেল রুমে সকাল থেকে কাজীদা রাশি রাশি গান রচনা করতেন, তাতে সুর দিতেন, আবার বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে সেই গানগুলি তুলে দিতেন। কারও জন্যে লিখতেন গজল, কারও দেশাত্মবোধক গান, কারও শ্যামাসংগীত, আবার কারও জন্য ইসলামী সংগীত। একাসনে বসে তিনি সংগীত রচনা করে যেতেন।’

কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গীতিনাট্য মধুমালার মহড়ার সময় নজরুল কি অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন তা জানা যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্মৃতিচারণা থেকে - ‘মহোৎসাহে কাজী সাহেবকে সন্ধ্যেবেলাতেই নিয়ে এলাম নাট্য-ভারতীতে। মঞ্চ-যাদুকর নানুবাবু (মণীন্দ্রনাথ দাস) দৃশ্যপট কিভাবে হবে তার পরিকল্পনা করতে বসলেন, আমাদের অভিনেত্রী-গোষ্ঠীতে নাচ-গানের সব মেয়েদের মহড়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল আর শ্রীমতী রাধারানী ও হরিমতিকে নেওয়া হলো অতিরিক্ত গায়িকা হিসেবে। সাত দিনের মধ্যে অভিনয়, প্রযোজনা কিন্তু করে দিতে হবে এই ছিল শর্ত। কাজী ও আমি রাজী হয়ে গেলাম- তখন দেখলাম কি নিষ্ঠার সঙ্গে সখির দল থেকে শুরু করে প্রত্যেক গায়িকাকে ধরে ধরে কাজী সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত গানের সুর আয়ত্ত করাচ্ছেন। দুপুর বেলা দশ মিনিট একটু যা হোক খাওয়া, আর সারাদিন শুধু পান ও চায়ের উপর নির্ভর করে সাতটা দিন যে অমানুষিক পরিশ্রম তিনি করেছিলেন তার তুলনা ছিল না।’

ছোট বোনের গান রেকর্ড করার জন্য মেগাফোন কোম্পানিতে গেছিলেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত। চাক্ষুষ করেছিলেন নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভা। তিনি লিখছেন, ‘‘হৃষ্টপুষ্ট এক ভদ্রলোক উজ্জল শ্যাম গাত্রবর্ণ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল বাবরীর মতো। পরনে ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি। সিল্কের চাদরটা একপাশে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। চমকে উঠলাম। কোথায় দেখেছি ওঁকে। বড় চেনা-চেনা। জিতেনবাবু ডাকলেন, ‘কাজী সাহেব’ - কাজী সাহেব তাকালেন, ‘বলুন’- ‘এই মেয়েটির দুটো গান রেকর্ড হবে’, বলে আমার বোনকে দেখালেন।
‘এসো এসো বসে যাও’, হাসতে হাসতে কাজী সাহেব বললেন। আমরা পাশে গিয়ে বসলাম। সেই আমার সাক্ষাৎ পরিচয় প্রথম কাজী সাহেবের সঙ্গে। আমার ধ্যানের কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী সাহেব আবার গান শেখাতে শুরু করলেন যাকে গান শেখাচ্ছিলেন। মেয়েটির রিহার্সেল হয়ে গেলে সে চলে গেল। তারপরই কবি আমার বোনের দিকে তাকালেন, ‘কি নাম তোমার?’
‘শোভা’।
‘বাঃ বেশ নাম’, বলেই পাশের একটা খাতা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন গান। মিনিট কুড়ির মধ্যে দুটো গান লেখা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সুর দিলেন, গাইলেন গান দুটি। চমৎকৃত হয়েছিলাম সেদিন কবির গান ও সুর রচনা দেখে। কেবল গানের কথাই নয় গানের সুরও যেন ওঁর আজ্ঞাবহ, কন্ঠে যেন স্বরস্বতীর অধিষ্ঠান।
দশ-বারো দিন রিহার্সেল হয়েছিল, সেই দশ-বারো দিনে কবির সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা জমেছিল সেই স্মৃতি আমার অমর হয়ে আছে স্মৃতির পাতায়। যেমন আমুদে তেমনি রসিক মানুষটা, কি প্রাণখোলা হাসি।’’

নজরুলের বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় যখন নন্দিনী ছবি করেন তখন খুব কাছ থেকে তিনি ট্রেইনার কাজী নজরুল ইসলামকে দেখার সুযোগ পান। তাঁর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে সেই সব সোনালী দিনের কথা- ‘‘একদিন গিয়ে দেখি শচীনদেব বর্মন মশাই একা নজরুলের কাছে বসে আছেন। আজকের দিনের ভারতখ্যাত শিল্পী ও সুরকার শচীনদেব বর্মন তখন সঙ্গীতের জগতে সবে প্রবেশ করেছেন। অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে প্রথম গান শিখতেন সুরকার শচীনদেব। তারপর তালিম নিতে এলেন নজরুলের কাছে। নজরুলের গানে এবং সুরে তিনি এমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন যে, তার সেদিনের তন্ময়তা ও একাগ্রতা ভোলবার নয়। কি এক অজানা আকর্ষণে দিনের পর দিন নজরুলের কাছে ছুটে আসতেন তরুণ গায়ক শচীনদেব। যেখানেই নজরুল সেখানেই শচীনদেব। যেন সুরের রাজার পাশে সুর-কুমার।

আমি তখন ‘নন্দিনী’ ছবি করছি। সেই ছবিতে নজরুলের একটি গান অন্ততঃ দিতেই হবে এই সংকল্প নিয়ে গিয়েছিলাম নজরুলের কাছে। গান তার তৈরিই ছিল। পল্লী সুরের গান। ‘চোখ গেল পাখী রে’। শিল্পীও তাঁর সামনেই বসে। ঠিক হলো শচীনদেবই গাইবেন এই গান। শিল্পীকে শেখানোও সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল। কিন্তু অসুবিধা বাধল প্রথম লাইনে। শচীনদেব বাবু ছিলেন পার্বত্য ত্রিপুরার রাজকুমার। বিরাট একটা সংগীতপ্রতিভা আর অপূর্ব সুরেলা কন্ঠ থাকা সত্ত্বেও নিখুঁত বাংলা উচ্চারণে তাঁর মাঝে মাঝে অসুবিধা হতো।
‘চোখ গেল, চোখ গেল’ বারবার তিনি বলতে লাগলেন ‘চো-গেল, চো-গেল’। খ উচ্চারণটি সাইলেন্ট হয়ে যেতে লাগল। নজরুলও কিছুতেই ছাড়বেন না। স্পষ্ট পরিষ্কার প্রাঞ্জল উচ্চারণ চাই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে দুজনের কসরত চললো। শচীনদেবও চো-গেল বলবেন আর নজরুল চোখ গেল বলাবে। গুরু এবং শিষ্যের সে কী নিষ্ঠা! সত্যই শচীনবাবু বুঝতে পারছেন তাঁর বারবার উচ্চারণে ভুল হচ্ছে অথচ গাইবার সময় শোধরাতে পারছেন না। সেদিন শচীনদেব বাবুর ভেতর যে নিষ্ঠা আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম তা আজও আমার স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।
শেষে ঠিক হলো ভারতলক্ষ্মী স্টুডিওতে গানটির রেকর্ডিং হবে আর নজরুল স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন। আমি সন্দেহ প্রকাশ করে বললাম - এত কাজের মাঝখানে সেটা কি তোমার পক্ষে সম্ভব হবে, না ছবির সংগীত-পরিচালক সুর-সাগর হিমাংশু দত্ত মশাইকে দিয়ে কাজটা চালিয়ে নেব?
সুর-সাগর হিমাংশু দত্তের ওপর নজরুলের ছিল অগাধ ভালোবাসা। আর হিমাংশুবাবুও নজরুলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। যথাসময়ে নজরুল গিয়ে উপস্থিত। মাথায় একমাথা বাবরি চুলের গুচ্ছ দুলিয়ে অট্টহাসি হেসে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললে - আমি এসেছি। সুর-সাগর কোথায়? চাঁটগেঁয়ে এসেছে তো? (শচীনদেবকে নজরুল আদর করে চাঁটগেঁয়ে বলতেন)। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে - তোমার ছবিতে এই গান আমি নিখুঁত করে গাইয়ে দেব। চল, স্টুডিওর ভেতরে যাই। ভেতরে শচীনবাবুও প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন। আবার চলল সেই কসরৎ।
প্রায় আধঘণ্টা চেষ্টার পর সফল হলেন কুমার শচীনদেব। আমার ছবিতে সেই তাঁর জীবনের প্রথম প্লে-ব্যাক। আমারই সামনে ‘নন্দিনী’ ছবির জন্য রেকর্ড করা হয় নজরুলের সেই দুটি কালজয়ী গান। ‘চোখ গেল পাখি রে’ আর ‘ও পদ্মার ঢেউ রে’। সে দুটি গানের ভেতর কুমার শচীনদেব বর্মণ আজও চিরনতুন হয়ে আছেন। সে গান দুটি নজরুল আর শচীনদেবের এক অমর সৃষ্টি, যুগ্ম প্রতিভার এক অম্লান স্বাক্ষর।’’

কানন দেবী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘একদিন জে এন ঘোষ মেগাফোনের রিহার্সাল রুমে কবির (নজরুল ইসলাম) সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে চেয়ে দেখি পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক হারমোনিয়ামের সামনে বসে আস্তে আস্তে বাজাতে বাজাতে গুনগুন করে সুর ভাঁজছেন চোখ বুজে। কখনও এধার ওধার তাকাচ্ছেন, কিন্তু কোনো কিছুর উপরই ঠিক যেন মন নেই। একসময় হারমোনিয়াম থামিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। দীপ্ত দুটি চোখের উজ্জ্বলতার মধ্যেই যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব কথা বলে উঠল। ঐ চোখ দুটিই যেন তাঁকে দেখিয়ে দেয়।...
আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে বলতেন, ‘ডাগর চোখে দেখছ কি? আমি এই হলাম ঘটক, জানো? এক দেশে থাকে সুর, অন্য দেশে কথা। এই দুই দেশের এই বর কনেকে এক করতে হবে কিন্তু দুটির জাত আলাদা হলে চলবে না, তা হলেই বে-বনতি। বুঝলে কিছু?’...

ছবির গান ও সুর বাঁধার সময়ও দেখেছি কত প্রচণ্ড আনন্দের মধ্যে কি প্রবল ভাবেই না কবি বেঁচে উঠতেন, যখন একটা গানের কথা ও সুর ঠিক তাঁর মনের মতো হয়ে উঠত। মানুষ কোনো প্রিয় খাদ্য যেমন রসিয়ে রসিয়ে আস্বাদ করে, কাজী সাহেব যেন তেমনি করেই নিজের গানকে আস্বাদ করতেন। শেখাতে শেখাতে বলতেন- ‘মনে মনে ছবি এঁকে নাও নীল আকাশ দিগন্ত ছড়িয়ে আছে। তার কোনো সীমা নেই, দুদিকে ছড়ানো তো ছড়ানোই। পাহাড় যেন নিশ্চিন্ত মনে তারই গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আকাশের উদারতার বুকে এই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোনোটা প্রকাশ করতে হলে সুরের মধ্যেও একটা আয়েস আনতে হবে। তাই একটু ভাটিয়ালির ভাব দিয়েছি। আবার ঐ পাহাড় ফেটে যে ঝর্ণা বেরিয়ে আসছে তার চঞ্চল আনন্দকে কেমন করে ফোটাব? সেখানে সাদামাটা সুর চলবে না। একটু গিটকিরি তালের ছোঁয়া চাই। তাই ‘রো-ও-ও-ও-অই-’ বলে ছুটল ঝর্ণা আত্মহারা আনন্দে। এমনই করে তিনি এই মেলানোর আনন্দ আমাদের হৃদয়েও যেন ছড়িয়ে দিতেন।’’

এভাবেই বহু গুণী মানুষের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছেন ট্রেইনার নজরুল।

তথ্য সূত্র: (১) শত কথায় নজরুল, সম্পাদনায় কল্যাণী কাজী
(২) নজরুল স্মৃতি, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
(৩) নজরুল জীবনী, ড. রফিকুল ইসলাম
(৪) সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

তথ্য সংগ্রহ: সোমঋতা মল্লিক
নজরুল সঙ্গীত শিল্পী এবং সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা)

মঙ্গল শোভাযাত্রা স্বনামেই বহাল রয়েছে: ইউনেসকো

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৮ পিএম
আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪০ পিএম
মঙ্গল শোভাযাত্রা স্বনামেই বহাল রয়েছে: ইউনেসকো

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিসেবে উদযাপন করেছেন এ বছর৷ তবে ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় এ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে এখনো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনেসকো৷

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিভাগের একজন মুখপাত্র খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের এই অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নাম পরিবর্তন করতে বাংলাদেশ সরকার এখনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আবেদন করেনি৷

তবে নাম পরিবর্তনের আবেদন করা হলেও তা ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংক্রান্ত বিশেষ একটি কমিটির অনুমোদনে স্বীকৃতি পাবে৷ 

ইউনেসকোর সেই মুখপাত্র বলেন, ‘অপরিমেয়  সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীল ও জীবন্ত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে, ইউনেসকোর এ তালিকায় কোনো উপাদানের নাম পরিবর্তনের জন্য একটি স্পষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে৷ এটি ওই কনভেনশনের পরিচালনাকারী সংস্থা — যা কি না ২৪টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত, সেই অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর করা হয়৷

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল শোভাযাত্রা ২০১৬ সাল থেকে ইউনেসকোর ‘মানবতার জন্য প্রতিনিধিত্বকারী’ তালিকায়  অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ইউনেসকোর অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ বিষয়ক কনভেনশনে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীল ও জীবন্ত প্রকৃতিকে সম্মান জানাতে বলা হয়েছে৷ অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কার্যক্রমকে বা এর চর্চাকারীদের প্রভাবিত করে এমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কাজকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতেও বলা হয়েছে৷

এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ইস্যুতে দেশ, বিদেশে নানা মহলে আলোচনা, সমালোচনা চলছে৷ চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শোভাযাত্রায় মঙ্গল শব্দটি থাকায় সমাজের নানা স্তরে ‘খারাপ প্রতিক্রিয়া’ হয়েছে৷ এছাড়াও ১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদ ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামেই তা উদযাপন করত৷ তাই চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, নাম পরিবর্তন নয়; কেবল পুরনো নামে ফিরে যাওয়া হয়েছে৷

তবে চারুকলা অনুষদের এ দাবি অগ্রাহ্য করেছেন শিক্ষার্থীদের একাংশ৷  তারা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মতো এবারও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হস্তক্ষেপে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে৷  তারা মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের যৌক্তিক কারণ খোলাসা করতেও চারুকলা অনুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷

জয়ন্ত সাহা/এমএ/

আমার জীবনটাই যুদ্ধের: জন্মদিনে হাশেম খান

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫১ পিএম
আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৫১ পিএম
আমার জীবনটাই যুদ্ধের: জন্মদিনে হাশেম খান
হাশেম খান

বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খানের ৮৪তম জন্মদিন আজ ১৬ এপ্রিল। ১৯৪১ সালের এ দিনে তিনি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার সেকদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

জন্মদিনের অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি গত ৫ বছর আগে আমার পরিবার পরিজন আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের বলেছিলাম, কেউ যেন আমার জন্মদিন উদযাপন না করেন। জন্মদিন নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি এটা উদযাপন করি না। কারণ বাবা-মাও আমার জন্মদিন উদযাপন করতেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বৈশাখের ৩ তারিখ জন্মেছিলাম আমি। মায়ের যখন প্রসব বেদনা ওঠে তখন বাইরে প্রচণ্ড কালবৈশাখী বইছিল। যখন আমি ভূমিষ্ঠ হলাম, তখন ঝড় থেমে গেল। ছোটবেলা থেকেই কত ঝড়ঝাপ্টার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠলাম। সারাটা জীবন আমি যুদ্ধই করে গেলাম। যে যুদ্ধ নিজের সঙ্গে, অন্যের সঙ্গে।’ 

ষাটের দশক থেকে শিল্পচর্চা ও সংস্কৃতির বিকাশে হাশেম খান বাংলাদেশের অগ্রজ ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারুকলা অনুষদে পড়িয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ইমেরিটাস অধ্যাপকের পদেও তিনি আসীন হয়েছেন। 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে রাজপথ যখন উত্তাল, হাশেম খান তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। সেই কিশোর বয়সে তিনি চাঁদপুর শহরে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয়-দফার লোগো তৈরি করেছিলেন। তৎকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোটেল ইডেনের সামনে যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন, তার নকশাও করেছিলেন হাশেম খান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে তিনি আঁকেন ঐতিহাসিক পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’। 

বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থের প্রতি পৃষ্ঠায় যে নকশা খচিত রয়েছে, তাতে প্রধান শিল্পী হিসেবে তিনি কাজ করেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রের তিনটি অ্যালবাম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শিল্পকলা সংগ্রহ অ্যালবামের তিনি যুগ্ম সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি ঢাকা জাদুঘর বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। 

হাশেম খান ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত স্বাধীনতা স্তম্ভের জুরিবোর্ড ও বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

শিল্পকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য হাশেম খান ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। 

২০২৪ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকের সহায়তায় হাশেম খানের সারা জীবনের নানা চিত্রকর্ম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘চিত্রকলা ভাস্কর্য ম্যুরাল ও ড্রইং ১৯৫৬-২০২৩’ শীর্ষক অ্যালবাম। 

বর্ষবরণে ডিএসসিসিতে নানা আয়োজন

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৪ পিএম
বর্ষবরণে ডিএসসিসিতে নানা আয়োজন
ছবি: খবরের কাগজ

তুমুল হর্ষে, আড়ম্বরে নববর্ষ বরণ করল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। বাংলা ভাষাভাষী ও বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সদস্যরা এ আয়োজনে অংশ নেন। 

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকালে নগরভবন প্রাঙ্গণে বৈশাখী বর্ণাঢ্য র‍্যালি, পান্তা ইলিশ উৎসব এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী প্রধান অতিথি হিসেবে বৈশাখী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।  

এদিন সকাল ৮ টায় নগর ভবন থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ র‍্যালি বের হয়ে গোলাপশাহ মাজার প্রদক্ষিণ করে পুনরায় নগর ভবনে এসে শেষ হয়। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন মনোজ্ঞ পরিবেশনা উপস্থাপন করেন ডিএসসিসি পরিচালিত  বিভিন্ন সংগীত শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষার্থী প্রশিক্ষকরা। 

রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, আজকের এই আনন্দ র‍্যালিতে আমরা যেমন ধর্ম, বর্ণ,পদবি নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেছি, ঠিক তেমনিভাবে সবাই মিলে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব। 

পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দশটি প্রশাসনিক অঞ্চলের ঐতিহ্য উপজীব্য করে নির্মিত প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন এবং পান্তা উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। উৎসবে স্থানীয় সরকার বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড.জিল্লুর রহমান, সচিব মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা উপস্থিত ছিলেন।

জয়ন্ত/মেহেদী/ 

নববর্ষ বার্তা দেয় নবপ্রত্যয়ের: অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫২ পিএম
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম
নববর্ষ বার্তা দেয় নবপ্রত্যয়ের: অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক
ছবি: খবরের কাগজ

জীর্ণ পুরাতনের পথ ছেড়ে এসে জাতীয় জীবনে শুভবোধ সঞ্চারের পথ অন্বেষণেই নববর্ষের সার্থকতা খুঁজে পান অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। শান্তি, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেশ গঠনের কথা বলেছেন তিনি।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বর্ষবরণ সংগীত, নববর্ষ বক্তৃতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।  এ আয়োজনে সভাপ্রধান ছিলেন একাডেমির সভাপতি আবুল কাসেম ফজলুল হক। 

তিনি  বলেন, নববর্ষ আমাদের নবপ্রত্যয়ে উদ্বুদ্ধ হওয়ার বার্তা দেয়। জীর্ণ পুরাতনের পথ পরিহার করে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে শুভবোধ সঞ্চারের কথা বলে। এবারের বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশ ও বিশ্বে বয়ে আনুক শান্তি সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতি।

আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। 'জাতিবাদের দ্বন্দ্ব সমাসে বাংলা বর্ষের ধর্ম পরীক্ষা' শীর্ষক নববর্ষ বক্তৃতা দেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, আমরা জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাগ্যবান যে, আমাদের নিজস্ব একটি নববর্ষ আছে, নিজস্ব একটি বর্ষপঞ্জি আছে। বাংলা নববর্ষ আমাদের ঋতুচক্রের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত তেমনি আমাদের উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গেও সম্পর্কিত। প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গে বৈশাখকে আমরা নানাভাবে আবিষ্কার করে চলি। 

ফারুক ওয়াসিফ বলেন, উৎসব মূলত তারুণ্যের প্রাণের শক্তিতে বেঁচে থাকে। আর তরুণেরা যুগে যুগে পুরাতনের মধ্যে নতুনকে মেশায় বলেই পুরাতনও বেঁচে থাকে নতুনের মধ্যে।  

সাংস্কৃতিক পর্বে সাঁঝ হিন্দোলের পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে। পরে সংগীত পরিবেশন করেন  সাইদুর রহমান বয়াতী, পিয়াল হাসান, এটিএম আশরাফ হোসেন, আশরাফুজ্জামান, ড. মাহবুবা রহমান, এলাহী মাসুদ, নাসরিন ফেরদৌস চমন, মনিরুল ইসলাম, সাকিব সুলেরী ও আবীর বাঙালি।  

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ছাড়ে বইয়ের আড়ং চলছে।  এখানে এসে স্বল্পমূল্যে মানুষ বই কিনতে পারবেন।

জয়ন্ত/মেহেদী/

আমরা নতুনের জয়গান গাইব: অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৩৫ পিএম
আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০১:৪৬ পিএম
আমরা নতুনের জয়গান গাইব: অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: খবরের কাগজ

বাঙালি যত মত ও পথেই বিশ্বাস করুক না কেন, বাংলা নববর্ষে এসে তারা পুরোপুরি বাঙালি হয়ে ওঠেন। আর সে বাঙালি সত্তার শক্তিতে ভর করেই পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বলে মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে রবীন্দ্র সরোবরে সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে 'হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ' অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

এর আগে ভোর ৬টায় যন্ত্রসঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এর পর শিল্পী স্বাতী সরকারের পরিচালনায় সুরের ধারার শিল্পীদের সম্মেলক পরিবেশনায় শুরু হয় এ বৈশাখী আয়োজন।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, 'আমাদের সময়ে উদ্‌যাপন যে খুব আলাদা ছিল তা না। আমাদের সময়ে অনেক কিছু নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু বাঙালির নববর্ষ নিয়ে মতপার্থক্য ছিল, এটা আমি দেখিনি। আমরা এভাবেই পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন করতাম। '

বাঙালি জাতীয় জীবনে পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য তুলে ধরে তিনি বলেন, 'অনেক পথ আছে, অনেক মত আছে।অনেক জীবনের বিশ্বাস আছে এখানে। একটা জায়গায় বিশ্বাসের ব্যতিক্রম নেই, সেটা হল নববর্ষ। নববর্ষে আমরা পুরোপুরি বাঙালি হই।' 

বাঙালি সত্তার মাহাত্ম্য নিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা যে পথেরই হই, যে বিশ্বাসেরই মানুষ হই না কেন, আজ আমরা সবাই বাঙালি হয়ে যাই।  বাঙালিকে যদি তার পায়ে দাঁড়াতে হয় তবে তাকে বাঙালি হয়েই দাঁড়াতে হবে। আমরা যেন চিরদিন বাঙালি হয়েই থাকি।' 

কৈশোরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, 'তখন ঢাকা শহরে মানুষ কম ছিল।আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে একা একা আবৃত্তি করতাম, চলে যেতাম। তখন আমায় কেউ পাগল বলবে কি? সে মানুষই তো ছিল না। রাস্তায় এত কম লোক ছিল। সে স্বাধীনতা নিয়েছি।'

এখন দিন বদলেছে, রাজধানীতে নাগরিক উৎসব মানে লোকে লোকারণ্য। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন,  'এখন কোনো স্বাধীনতা নেই। শুধু শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা।' তবুও নগর জীবনে আজ যে উৎসব তাকে নানা উপচারে বরণ করে নিতে তো হবেই। 

তিনি বলেন, 'নব মানে নতুন, আমরা আজ নতুনের জয়গান গাইব।'

অনুষ্ঠানে হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ' অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ফেরদৌস আরা, ফাহিম হোসেন, কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, অনন্যা আচার্য, শারমিন। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়।

জয়ন্ত/মেহেদী/