দেশে ধর্ম, জাতি, বিত্তের বিভাজন ভেঙে সব মানুষের স্বস্তি নিশ্চিত করে সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ গঠনের বার্তা এলো নতুন বঙ্গাব্দে। আজ পয়লা বৈশাখ। বাংলা বর্ষে দিনপঞ্জিকার পাতা উল্টে আজ যে নতুন দিন এসেছে তাকে সুরে-সুরে বরণ করে নিলেন সংগীতায়ন ছায়ানটের শিল্পীরা।
বাঙালির আবহমান সংস্কৃতি হৃদয়ে ধারণ করে মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম করতে একতার কথাই ধ্বনিত হয়েছে রাজধানীর রমনা উদ্যানের বটমূলে।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) ভোর সোয়া ৬টায় শুরু হয় ছায়ানটের নববর্ষ বরণের আয়োজন। সুপ্রিয়া দাশ রাগ ‘ভৈরবী’- স্বাগত জানান নতুন ভোরকে। সম্মেলক গানের পর্বে এদিন ছায়ানটের শিল্পীরা শুনিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত।
‘নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’; ‘সকলকলুষতামসহর, জয় হোক’; ‘মোরা সত্যের পরে মন’; ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী’, ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম’, আব্দুল লতিফের ‘এই বাংলা রবি ঠাকুরের’, সলিল চৌধুরীর ‘ও আলোর পথযাত্রী’, নুরুল ইসলাম নাহিদের ‘আজ আইলো রে বছর ঘুরি’।
ফিলিস্তিনের নিপীড়ত মানুষদের প্রতি সংহতি জানাতে অনুষ্ঠানের এক পর্বে শিল্পী ও দর্শকরা দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
একক গান পর্বে চন্দনা মজুমদার শোনান লালন সাইজিঁর গান ‘মন সহজে কি সই হবা’। খায়রুল আনাম শাকিল শোনান কাজী নজরুল ইসলামের ‘গগনে প্রলয় মেঘের মেলা’; লাইসা আহমদ লিসা শোনান ‘আকাশে দুই হাতে প্রেম বিলায়’; সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা শোনান নজরুলের ‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়; সুস্মিতা দেবনাথ শুচি শোনান ‘মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ’; আবুল কালাম আজাদ শোনান ‘এ বিশ্ব মাঝে যেখানে যা সাজে’; দীপ্র নিশান্ত শোনান ‘তিমির দুয়ার খোলো’; সেঁজুতি বড়ুয়া শোনান ‘আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ’।

মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য শোনান রবীন্দ্রনাথের ‘ভেঙেছো দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়’; ফারজানা আক্তার পপি শোনান ‘তোর ভিতরে জাগিয়া কে যে’; সুমন মজুমদার শোনান ‘জগতের নাথ করো পার হে’।
একক আবৃত্তি পর্বে জহিরুল হক আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঝড়ের খেয়া’ কবিতার নির্বাচিত অংশ; সুমনা বিশ্বাস পাঠ করেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘দাও শৌর্য, দাও ধৈর্য’; জয়ন্ত রায় পাঠ করেন অনিকেত রাজেশের ‘সভ্যতা’-র নির্বাচিত অংশ।
এ বছর নববর্ষ কথন পাঠ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. সারওয়ার আলী।
শুরুতে তিনি বঙ্গাব্দ বরণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘মুক্তির অন্বেষায়, দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় অর্ধশতকবর্ষ পূর্বে বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ওই যাত্রাপথের নানা নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতসহ সকল মাধ্যম এবং বিভিন্ন স্থাপনায়। বাঙালির স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব, নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার আয়োজন।’
গত বঙ্গাব্দে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের নানা স্মৃতি এখন জাগরুক নাগরিক মানসপটে। সেই গণঅভ্যুত্থান অমিত সম্ভাবনার ছবি এঁকে দিলেও এখন সমাজকে পীড়া দিচ্ছে নানা বিদ্বেষ, বিভক্তি। অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতায় কেঁদে উঠছে মানবতা।
সারওয়ার আলী বলেন, ‘বাঙালির মানবতার মুক্তিসাধনা স্বাধীন আপন দেশেও প্রত্যাশা এবং আশাভঙ্গের নানান চড়াই উতরাইয়ের দোলাচল প্রত্যক্ষ করেছে। নববর্ষের ঊষালগ্নে, আজ চোখ ফেলি হিসেব-নিকেশের হালখাতায়। একদিকে মুক্তির জন-আকাঙ্ক্ষা অর্জনের প্রত্যাশা, অন্যদিকে পীড়াদায়ক বিদ্বেষ-বিভক্তি, নারী-শিশুর অমানবিক মর্যাদাহানি ও অপরিণামদর্শী অসহিষ্ণুতা। সকল অতৃপ্তি প্রতিবিধানের দায় রাষ্ট্রের, তবে সমাজকেও সে দায় নিতে হয় বৈকি।’
এমন সময়ে সব বিভাজনের দেয়াল ভেঙে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ গঠনের বার্তা দেন সারওয়ার আলী।
তিনি বলেন, ‘আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি-বিত্তের বিভাজন ভাঙবে, গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ। সকলে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে, মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবে।’
জয়ন্ত/অমিয়/