ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।।
ধূলির ধরা বেহেশ্তে আজ জয় করিল দিলরে লাজ।
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।।
মহানবীর (সা.) আবির্ভাব দিবসে কাজী নজরুল ইসলাম রচিত এই গানটির কথা বিশেষ ভাবে মনে পড়ে। আরবের মরু প্রান্তরে মা আমিনার কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাঁর আগমন বিশ্ববাসীকে আনন্দিত করে তোলে। তারই চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় উপরোক্ত গানটিতে। শুধুমাত্র এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই নয়, ইসলাম ধর্মের বহু অনুষঙ্গ নজরুলের গান ও কবিতায় পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষায় অত্যন্ত সার্থকভাবে ইসলামী সঙ্গীত রচনা করেছিলেন আমাদের প্রাণের কবি। তাঁর রচিত একাধিক ইসলামী গান বাংলা সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ। ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গানটিতে নজরুল মানবতার দূত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন বার্তা দিয়েছেন। মানুষের মুক্তির জন্যই তাঁর আগমন - ‘মানুষে মানুষের অধিকার দিল যে জন/এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই কহিল যে জন/ মানুষের লাগি চির-দীন বেশ ধরিল যে- জন/ বাদশা ফকিরে এক সামিল করিল যে জন/ এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী/ ব্যথিত- মানবের ধ্যানের ছবি/ আজি মাতিল বিশ্ব-নিখিল মুক্তি-কলরোলে’।
পারিবারিক কারনেই নজরুল, ইসলাম ধর্মের চেতনাকে শৈশব থেকেই অন্তরে ধারণ করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত জীবনে তার প্রতিফলন দেখা যায়। বিশিষ্ট নজরুল গবেষক আবদুল আযীয আল্-আমান ‘নজরুলের ইসলামী সঙ্গীত’ প্রবন্ধে লিখেছেন - ‘মূলহীন অবস্থায় বিশাল মহীরূহ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। জন্মসূত্রেই হয়েছিলেন নজরুল কয়েকটি বিশেষ সুবিধার অধিকারী। তিনি মুসলমান এবং শৈশব-কৈশোরে লেখাপড়া করেছেনও মক্তবে। সুতরাং বাল্যকাল থেকেই ইসলাম ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর একটি স্পষ্ট ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠে। মোল্লাগিরি এবং নামাজ পরিচালনায় দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রাক্ যৌবনের সেই স্বপ্নময় হয়ে ওঠার দিনগুলিতে ধর্মের সঙ্গে স্থাপিত হয় এক অবিচ্ছেদ্য হার্দিক সম্পর্ক - যার প্রভাব তাঁর জীবনে হয়ে ওঠে খোদিত শিলালিপির মতো স্থায়ী। ইসলামের বিপুল ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। ইসলামী সঙ্গীত রচনার পূর্বে ধর্ম ও ঐতিহ্যাশ্রয়ী যে সব অনবদ্য ইসলামী কবিতা রচনা করেছিলেন, প্রত্যেকটির পটভূমি ছিল আন্তর্জাতিক।’
১৩৪৭ বঙ্গাব্দে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ঈদ-সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার মুসলমান তরুণদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরেন- ‘‘সকল ভীরুতা, দূর্বলতা, কাপুরুষতা বিসর্জন দিতে হবে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নয়, ন্যায়ের অধিকারের দাবিতেই আমাদিগকে বাঁচতে হবে। আমরা কারও নিকট মাথা নত করব না। রাস্তায় বসে জুতো সেলাই করব, নিজের শ্রমার্জিত অর্থে জীবন যাপন করব, কিন্তু কারও দয়ার মুখাপেক্ষী হব না। এই স্বাধীন চিত্ততার জাগরণ আজ বাংলার মুসলমান তরুণদের মধ্যে দেখতে চাই। এই ইসলামের শিক্ষা। এই শিক্ষা সকলকে গ্রহণ করতে বলি। আমি আমার জীবনে এ শিক্ষাকেই গ্রহণ করেছি। দুঃখ সয়েছি, আঘাতকে হাসিমুখে বরণ করেছি কিন্তু আত্মার অবমাননা কখনো করিনি। নিজের স্বাধীনতাকে কখনো বিসর্জন দিইনি। ‘বল বীর চির উন্নত মম-শির’-এ আমি আমার শিক্ষার অনুভূতি থেকেই পেয়েছি। এই আজাদ-চিত্তের জন্ম আমি দেখতে চাই। ইসলামের ইহাই সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী। ইসলামের ইহাই মর্মকথা।’’ নজরুল তাঁর গানে ভেদাভেদ ভুলে সকলকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন -
হাতে হাত দিয়ে আগে চলি, হাতে নাই থাক্ হাতিয়ার।
জমায়েত হও, আপনি আসিবে শক্তি জুলফিকর।।
আন্ আলীর শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ ওমরের মত কর্মানুরাগ;
খালেদের মত সব অশান্ত ভেঙে কর একাকার।।
১৯৪০ সালের ২৩শে ডিসেম্বর, রবিবার, কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে কলকাতা মুসলিম-ছাত্র সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে কাজী নজরুল ইসলামের প্রদত্ত ভাষণ ‘আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন - ‘‘আমি আল্লাহর পবিত্র নাম নিয়ে এই আশার বাণী শোনাচ্ছি - তিনি প্রকাশিত হবেন তোমাদেরই মাঝে। জরাজীর্ণ দেহে নয়, তোমাদের আকাঙ্ক্ষা, তোমাদের প্রার্থনা আমার মতো মহা-মূর্খকে লিখালেন কবিতা, গাওয়ালেন গান - তাঁর শক্তি এই নাম-গোত্রহীনের হাতে দিলেন আশার বাঁশি, আহ্বানের তূর্য, রুদ্রের ডমরু বিষাণ। তোমরা চাও - আরও চাও - দেখবে তোমাদেরই মাঝে চির-চাওয়া রুদ্র-সুন্দর আসবেন নেমে।’’
১৮৯৯ সালের ২৪মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল। চুরুলিয়ায় যে পরিবেশে তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয়, সে সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন মঈনুদ্দিন - ‘‘নজরুলের বাবা ফকির আহম্মদ সাহেব ছিলেন খুবই ধার্মিক মানুষ। সবসময় তিনি নামাজ, রোজা আর তস্বীহ তেলাওয়াত নিয়ে মশগুল থাকতেন। তাঁদের বাড়ির কাছেই ছিল ‘পীর-পুকুর’ নামে এক মস্ত দীঘি। তার পাড়ে হাজী পাহ্লোয়ান নামে এক পীর সাহেবের মাজার শরীফ আর একটি মসজিদ। এই মাজার আর মসজিদের খেদমত করেই ফকির আহম্মদ সাহেব সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। নজরুলের বাবা তাঁকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে কিছু-কিছু ফারসী আর কুর্আন শরীফ পড়েছিলেন। দুষ্টু ছেলেদের একটা মজা এই যে, দুষ্টুমিতেও তারা যেমন ওস্তাদ, আবার পড়াশোনায়ও তারা হয় সবচাইতে ভালো। নজরুল ইসলামের বেলায়ও এই কথাটি সত্য। দশ বৎসর বয়সে যখন তিনি মক্তবের পড়া শেষ করলেন, তখন দেখা গেল, তিনি যেটুকু শিখেছেন তার মধ্যে কোন গলদ নেই। কোন ফাঁকি নেই। এই বয়সেই তিনি উর্দু আর ফারসি এমন সুন্দর ভাবে উচ্চারণ করতেন যে তা শুনে সবার তাক্ লেগে যেতো। তাঁর খোশ্ এল্হানে কুর্আন শরীফ তেলওয়াৎ শুনে বড়-বড় মৌলবী মওলানা সাহেবান্ খুশিতে তাঁর পিঠ চাপড়াতেন।’’
পরবর্তীকালে শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে যিনি ছিলেন নজরুলের পার্সী শিক্ষক, সেই হাফিজ নুরুন্নবী ছিলেন নজরুল-সুহৃদ মুজফ্ফর আহ্মদের বন্ধু। ১৯১৫ সালে দু-মাসের জন্য খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। তখন ঐ মাদ্রাসার হেড মৌলবী ছিলেন হাফিজ নুরুন্নবী। সমস্ত কুর্আন তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। ইংরেজিও তিনি মোটামুটি জানতেন। তিনি কবিত্বময় উর্দু গদ্য লিখতেন। তাই মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে মুজফ্ফর আহ্মদের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় - ‘‘নজরুলকে সঙ্গে নিয়ে খিদিরপুরে শাহ্ আমান লেনে হাফিজ নুরুন্নবীর বাড়ীতে গিয়েছিলেম।... শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে হাফিজ নুরুন্নবী যখন পার্সী ভাষায় শিক্ষকরূপে ১৯১৫ সালে যোগ দিয়েছিলেন তখন নজরুল দ্বিতীয় ভাষারূপে সংস্কৃত পড়ছে। সেই স্কুলে মৌলবি আব্দুল গফুর নামে আরও একজন যে পার্সী ভাষার শিক্ষক ছিলেন তাঁর আর নজরুলের মধ্যে না কি কখনও সুখকর সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। সে যাই হোক, নুরুন্নবী নজরুলকে পার্সীর ক্লাসে টেনে এনেছিলেন। তিনি সাহিত্যক রুচি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন বলে নজরুল তাঁর প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল।’’

বাল্য বয়সে নজরুল তাঁর কাকা কাজী বজলে করিমের সাহচার্য লাভ করেন। সেই সময় লেটোর দলে নজরুল যোগ দেন। বেশ কিছু পালা রচনার পাশাপাশি ইসলামী গানও তিনি রচনা করেন। সেই রকমই একটি গান -
আমিনা দুলাল নাচে হালিমার কোলে।
তালে তালে সোনার বুকে সোনার তাবিজ দোলে।।
কাঁদলে পরে মুক্তো ঝরে,
হাসলে পরে মানিক পড়ে,
ও তাঁর কচিমুখে খোদার কালাম আধ আধ বোলে।।
আরেকটি গানেও একই সুর ধ্বনিত হয়েছে-
ইসলামের বাণী লয়ে কে এলো ধরাতে।
কে এলো আঁধারে নূর বাতি জ্বালাতে।।
রবিয়ল আউয়ল মাসে,
কে এলো নিশি শেষে,
নূরের শরীর ধরে, মা আমিনার কোলেতে।।
সে যে ইসলাম রবি,
মোহাম্মদ খোদার নবী,
নিখিল প্রেম ছবি, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মুখেতে।
সে যে রহমতে খোদা,
খোদা প্রেমে রহে সদা,
ধরণীর বুকে এলেন কলেমা বিলাতে।।
পরবর্তীকালে বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সমস্ত ধরাকেই সমৃদ্ধ করেছেন নজরুল। আবদুল আযীয আল্ আমানের লেখা থেকে জানা যায় - উর্দুতে গজল গান ও ইসলামী সঙ্গীতের অসংখ্য রেকর্ড থাকলেও বাংলা ভাষায় ইসলামী সঙ্গীতের একখানি রেকর্ডও ছিল না। এ ব্যাপারে প্রথমে তৎপর হয়ে ওঠেন আব্বাসউদ্দীন। নজরুলের বাণী এবং আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠ - দু’য়ে মিলে নিখিল বাংলায় ইসলামী সঙ্গীতকে একটি অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য দান করেছিল। বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলাম কিভাবে ইসলামী গান রচনা করলেন তার চমৎকার বর্ননা পাওয়া যায় আব্বাসউদ্দীন আহ্মদের স্মৃতি কথা থেকে।
‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন - ‘‘একদিন কাজীদা কে বললাম, কাজীদা একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায় এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়। এই ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন কিভাবে কাফের, কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাংক্তেয় করে রাখবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ। আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান। কথাটা তাঁর মনে লাগল। তিনি বললেন আব্বাস তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তাঁর মত নাও, আমি ঠিক বলতে পারব না। আমি ভগবতী ভট্টাচার্য অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ইন-চার্জকে বললাম। তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না না না ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।’’
মনের দুঃখ মনেই চেপে গেলাম। এর প্রায় ছ’মাস পরে একদিন দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল, আমি অফিস থেকে গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সাল ঘরে গিয়েছি। দেখি একটা ঘরে বৃদ্ধা আশ্চর্যময়ী আর বৃদ্ধ ভগবতী বাবু বেশ রসাল গল্প করছেন। আমি নমস্কার দিতেই বৃদ্ধ বললেন, ‘বসুন - বসুন।’
আমি বৃদ্ধের রসাপ্লুত মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম এই-ই উত্তম সুযোগ। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলি। সেই যে বলেছিলাম ইসলামী গান দেবার কথা, আচ্ছা একটা এক্সপেরিমেন্টই করুন না, যদি বিক্রি না হয় আর নেবেন না, ক্ষতি কি? তিনি হেসে বললেন ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি, আচ্ছা আচ্ছা করা যাবে।’
শুনলাম পাশের ঘরে কাজীদা আছেন। আমি কাজীদাকে বললাম যে ভগবতী বাবু রাজী হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজীদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজীদা বলে উঠলেন ‘ইন্দু তুমি বাড়ী যাও। আব্বাসের সাথে কাজ আছে।’ ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোংগা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘণ্টার ভিতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, তখুনি সুরসংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’। গান দুখানা লেখার ঠিক চার দিন পরেই রেকর্ড করা হলো। কাজীদার আর ধৈর্য্য মানছিল না। তাঁর চোখেমুখে কি আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল। তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গান দু’খানা আমার তখন মুখস্থও হয়নি। তিনি নিজে যা লিখে দিয়েছিলেন মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক আমার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সে কাগজখানা ধরলেন, আমি গেয়ে চললাম। এই হলো আমার প্রথম ইসলামী রেকর্ড। দু’মাস পরে ঈদুল ফিতর। শুনলাম গান দু’খানা তখন বাজারে বের হবে।’’
১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আব্বাসউদ্দীন আহ্মদের কণ্ঠে প্রথম ইসলামী গানের রেকর্ড হয়। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্পী সাকিনা বেগম - প্রথম নারী কণ্ঠে ইসলামী গান - নামাজ রোজা হজ্ যাকাতের রেকর্ড করা হয়। এভাবেই একের পর এক ইসলামী গান রচনা করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আব্বাসউদ্দিনের কথায় - ‘আল্লাহ রসুলের গান পেয়ে বাংলার মুসলমানের ঘরে ঘরে জাগিল এক নব উম্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আঙুল দিত তাদের কানে গেল, ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি’, ‘নাম মোহাম্মদ বোলরে মন, নাম আহ্মদ বোল’। কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল এ গান। আরও শুনল ‘আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়’। মোহর্রমে শুনল মর্সিয়া, শুনল ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়’। ঈদে নতুন করে শুনল ‘এলো আবার ঈদ, ফিরে এলো আবার ঈদ, চলো ঈদ গাহে’। ঘরে ঘরে এলো গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আল্লাহ রসুলের নাম। কাজীদাকে বললাম কাজীদা মুসলমান তো একটু মিউজিক মাইন্ডেড হয়েছে। এবার তরুণ ছাত্রদের জাগাবার জন্য লিখুন। তিনি লিখে চললেন ‘দিকে দিকে পুনঃজ্বলিয়া উঠিছে’, ‘আজি কোথায় তখ্তে তাউস, কোথায় সে বাদশাহী’।

নজরুল গবেষক সঙ্গীতজ্ঞ ড. রশিদুন নবী নজরুল রচিত ইসলামী গানকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন -
১) হামদ্- যেমন: এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল, আল্লা নামের বীজ বুনেছি
২) নাত- যেমন: মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা, আসিছেন হাবীবে খোদা
৩) আল্লাহ রসুল- যেমন: ভোর হলো ওঠ জাগ মুসাফির, আল্লাহকে যে পাইতে চায়
৪) ইসলামী জাগরণী গান- যেমন: আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান, তৌফিক দাও খোদা ইসলামে
৫) মর্সিয়া - যেমন: এলো শোকের সেই মোহর্রম, ওগো মা ফাতেমা ছুটে আয়
৬) পবিত্র স্থানের মাহাত্ম্যসূচক গান- (আরব, মক্কা, মদিনা ইত্যাদি) যেমন: আমি যদি আরব হতাম, আমি যেতে নারি মদিনায়
৭) ধর্মের পঞ্চভিত্তিক বিষয়ক গান ( কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত) যেমন: নামাজ -রোজা - হজ - জাকাতের পসারিণী আমি, দে জাকাত দে জাকাত
৮) ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বিষয়ক গান- (ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ইত্যাদি) যেমন: ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, ঈদ মোবারক হো
৯) বিবিধ - যেমন: চলরে কাবার জিয়ারতে, দূর আজানের মধুর ধ্বনি বাজে।
আসাদুল হকের লেখা ‘নজরুল যখন বেতারে’ বইটি থেকে জানা যায় - বেতারের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম ‘ঈদজ্জোহা’ নামক একটি গীতি আলেখ্য রচনা করেন। ১৯৪১ সালের ৯ই জানুয়ারি তারিখে রাত ৮টা ০৫ মিনিট হতে রাত ৮টা ২৯ মিনিট পর্যন্ত প্রচারিত হয় নজরুল রচিত, সুরারোপিত ও পরিচালিত সঙ্গীতালেখ্য ‘ঈদজ্জোহা’। গীত ভূমিকায় ছিলেন রাধারাণী, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায় (রানী) চিত্তরায় এবং আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ।
শেখ দরবার আলমের ‘অজানা নজরুল’ গ্রন্থের ‘কলকাতা বেতারে নজরুল: তার আজান ও কোরআন পাঠ’ প্রবন্ধ থেকে জানা যায় - ২৩শে অক্টোবর ১৯৪১ তারিখ, বৃহস্পতিবার ঈদ-উল-ফিতরের দিন সকাল সাড়ে ছয়টায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র থেকে বিশেষ প্রাতঃকালীন একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি পরিকল্পনা করেন কামাল চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি রচনা ও পরিচালনা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। দরবার আলম ২রা অক্টোবর, ১৯৪১ তারিখ, বুধবারের আনন্দবাজার পত্রিকায় উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন-
১) আজান ও পবিত্র কোরআন পাঠ : কাজী নজরুল ইসলাম।
২) নাটিকা : কাজী নজরুল ইসলাম লিখিত।
তিনি আরও বলেছেন, যন্ত্রীসঙ্গের সাহায্যে : কাজী নজরুল ইসলাম, চিত্তরঞ্জন রায়, মোহাম্মদ হোসেন (খসরু), কামাল চৌধুরী, রেহানা বেগম এবং আফরোজ আকতার কর্তৃক অভিনীত। অনুষ্ঠানসূচিতে ঈদ মোবারক সম্বন্ধে বাংলায় মফিজ উদ্দিন চৌধুরীর আলোচনা, কামাল চৌধুরীর আবৃত্তি ও সম্মিলিত সঙ্গীতও ছিল। এভাবেই বাংলা সঙ্গীতের অন্যান্য ধারার পাশাপাশি নজরুল রচিত ইসলামী সঙ্গীত যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। ইসলামী সঙ্গীতগুলো শুনতে শুনতে মনে হয় কবি অতি সুনিপুণভাবে কথা ও সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। শুধু মুগ্ধ হওয়া ছাড়া শ্রোতাদের আর কিছুই করার থাকে না।
আবদুল আযীয আল্-আমান যথার্থই বলেছেন - ‘নজরুল-পূর্বে রচিত ইসলামী সঙ্গীতে কিছু ভাব গভীরতা ছিল। আরবি, ফারসি শব্দ ছিল। ইংগিত ছিল মরমী ভাবেরও। সব থেকেও যা ছিল না তা হলো ‘আধুনিক শরীর’। এক দুর্লভ কবি প্রতিভায় নজরুল কিন্তু তার ইসলামী সঙ্গীতগুলিকে সমৃদ্ধভাবে আধুনিক করে তুললেন। এই আধুনিকতা এসেছে সংগীতাংগিকের দিক থেকে, ভাব সম্পদের দিক থেকে, রূপ কল্পনা, শব্দ সম্ভার, ছন্দৈশ্বর্য এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা প্রয়োগ নৈপুণ্যের দিক থেকে। এ যেন শৈশব দেহে অবিশ্বাস্য ভাবে বিপুল যৌবন সঞ্চার।’
তথ্যসূত্র:
১) নজরুল-সংগীত সংগ্রহ : কাজী নজরুল ইসলাম
২) নজরুলের অভিভাষণ : নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত
৩) নজরুল স্মৃতি : বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
৪) কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা : মুজফ্ফর আহ্মদ
৫) নজরুল তাঁর সৃজন বিশ্বে: আবদুল আযীয আল্-আমান
৬) আমার শিল্পী জীবনের কথা : আব্বাসউদ্দীন
আহ্মদ
৭) কাজী নজরুল ইসলাম - এর অপ্রকাশিত লেটো গান: সংকলন ও সম্পাদনায় মুহম্মদ আয়ুব হোসেন
৮) নজরুল সঙ্গীতের নানা অনুষঙ্গ : রশিদুন নবী
৯) নজরুল যখন বেতারে: আসাদুল হক
