
বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী এক বিস্ময়। গত শতকের নয়ের দশক থেকে যখন আমরা তার রচিত কথাসাহিত্য পড়তে শুরু করি, তার আগে তাকে মূলত আমরা জানতাম একজন কবি হিসেবে। বহু পত্রপত্রিকায় স্মরণজিতের কবিতা আমরা পড়েছি। মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েছি। পড়ে মন ভালো হয়েছে। দুঃখের তিমিরের উজানে বওয়া এক ফল্গুধারা মনে হয়েছে তার কবিতা।
মুগ্ধচিত্তে যখন তার ছোটগল্প এবং উপন্যাস পড়তে শুরু করলাম। তার গদ্য পড়ার প্রথম দিকেই আমরা ভেবেছিলাম, বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে একটা নতুন ধারার সংযোজন হতে চলেছে। আমাদের সেই প্রত্যাশা আজ অবধি পূরণ করে চলেছেন স্মরণজিৎ। সময়োচিত বিন্যাসে সময়কে ধরার এক অদ্ভুত জাদুকাঠি লুকিয়ে আছে তার কলমে।
গত শতকের নয়ের দশকে স্মরণজিতের লেখা যখন আমরা প্রথম পড়ি, তখনো সময়ের বদলকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমাজের ভ্রুকুটি বেশ বড় রকমেরই ছিল। সাতের দশক বা আটের দশকেরও যে বাঙালি সমাজের প্রেম, বিশেষ করে শহুরে মানুষজনের প্রেম, সেখানে সমাজের ভাঙাগড়ার এক অদ্ভুত বিন্যাস ছিল। যে বাঙালিসমাজ নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যদিয়ে প্রেমের জয়গান গাইছে, কিন্তু সেই জয়গান গাওয়ার জন্য কুশীলবদের যে সংগ্রাম বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠা প্রেম বা শরীর- এসব নিয়ে লিখতে গেলে সমাজ তখন নাক শিটকোচ্ছে। লেখককে দূর দূর করেছে। আদালত পর্যন্ত টানাটানি হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু থেকে সমরেশ বসু- এই সময়কালটাও আমরা দেখেছি।
তাই যখন নয়ের দশকের গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক অদল-বদলের সমসাময়িকতায় আমরা স্মরণজিৎতের লেখা পাচ্ছি, যে খোলা হাওয়া স্পন্দন তার লেখার মধ্যদিয়ে আমাদের মনের গহিন কুঠুরিকে আনন্দে মাতাচ্ছে, তা যেন সত্যিই এক অভিনব। তখন মনে হচ্ছে; সময়ের বদলকে যদি লেখক ধরতে না পারেন, তাহলে তো সেই চার্লস ডিকেন্সে সময়ের বর্ণনার প্রেক্ষিত, লেখায় অনুল্লিখিতই থেকে যাবে।
সময়কে ধরতে পারাই তো লেখকের সব থেকে বড় মুনশিয়ানা। আর এই মুনশিয়ানা প্রকাশের ক্ষেত্রে সময়ে অবস্থান করে, সময়ের কুশীলবদের যদি উপলব্ধিতে লেখক না আনতে পারেন- তবে সেই লেখার মধ্যে ‘সময়’ নামক মহাকালটি আদৌ ধরা দেয় না। সময়ের প্রেক্ষিত ঘিরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ‘সেই সময়’ বা ‘প্রথম আলো’র মতো মহাকাব্য রচনা করছেন, তখন তো পড়তে পড়তে আজও আমাদের মনে হয় লেখক বোধ হয় সেই সময়কালে অবস্থান করা কোনো ব্যক্তিত্ব।
আবার যখন ‘ছিন্নবাধা’ থেকে ‘যুগ যুগ জীয়ে’ হয়ে ‘প্রজাপতি’, ‘পাতক’, ‘বিবর’ রচনা করছেন সমরেশ বসু, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আমাদের মনে হয় যেন স্বকালে অবস্থান করেই সেই সময়কে সাহিত্যের প্রতিবিম্বে বিম্বিত করছেন লেখক।

স্মরণজিৎ ভাবীকাল বা অতীতকাল ঘিরে খুব লেখেন না। তার লেখায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার নিজের সময়টা নানা বর্ণিল রূপ নিয়ে ফুটে ওঠে। যেখানে দুঃখ আছে। যন্ত্রণা আছে। কষ্ট আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে আছে এক অপার আনন্দ। দুঃখের সাম্রাজ্যই যে মানুষের জীবনের শেষ কথা নয়, আগামীর দিকে এগিয়ে যাওয়া- সেটাই হলো দুঃখকে অতিক্রম করার মহৌষধ- স্মরণজিৎ তার প্রতিটি লেখাতেই যেন নিত্যনতুন করে সেই বার্তাই আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। সে বার্তাটি যেমন কিশোর, তরুণ, সদ্য যুবকদেরও উদ্ভাসিত করছে। ঠিক তেমনিই যৌবন উপান্তে এসে কিংবা প্রৌঢ়ত্বে ভাসতে ভাসতে একজন মানুষ, নিজেকে কান্না-হাসির দোল দোলানোর মধ্যদিয়ে নতুন করে উপলব্ধি করবেন, জীবনযন্ত্রণাকে বইয়ে যাওয়ার মধ্যে ‘হতাশা’ এই শব্দটির কোনো জায়গা নেই। এই বোধ থেকেই যেন স্মরণজিৎ তার সৃষ্টির পাল তুলে দিয়েছেন।
নতুন প্রজন্মের যেন হৃদস্পন্দন উপলব্ধি করতে পারেন স্মরণজিৎ। তার লেখার প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে সদর এবং মফস্বলের এক অদ্ভুত শব্দ যেন আমরা শুনতে পাই। শাকিন কলকাতা, মহানগরের একদম প্রাণকেন্দ্রে থাকা একজন কিশোর-তরুণ-যুবক, তার ভাবনার খেয়াতরী, আবার শহরতলির সমবয়স্ক মানুষের আঙ্গিকের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য। আবার যেন একটি দূর কোন দিকশূন্যপুরের এক শ্যামলা কিশোরীর মনের কথা। বেঁচে থাকার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ের মধ্যে সব সময় একটা প্রাণস্পন্দন। কোনো হতাশা নয়। হতাশাকে অতিক্রম করতে পারার এক অদ্ভুত মৃতসঞ্জীবনী সুধা- এটাই হলো স্মরণজিৎতের লেখার একটা নির্যাস।
যারা বেঁচে থাকার আনন্দে আনন্দ পান না- তাদের কারও কারও কাছে এই বেঁচে থাকার আনন্দের মধ্যে এক ধরনের পুনরুক্তির ধারণা মালুম হয়। আসলে বেঁচে থাকাটাই যে নিত্যনতুন আনন্দের আনাগোনার মধ্যদিয়ে, দিনের পরে দিনকে কাটিয়ে দেওয়া- এ উপলব্ধি যারা করতে পারেন না, তাদের মনে হয় সময়ের কথকথা হলো থোরবরি খাড়া। তারা সময়কে কল্পনার জগতে রঞ্জিত করে, সময়ের থেকে দূরে নিয়ে গিয়ে, এক ধরনের কৌতুকে করুণায় অবসর বিনোদনের উপকরণ হিসেবে নিজেকে দেখতে ভালোবাসেন। তাই তাদের কাছে মনে হয় স্মরণজিৎতের লেখায় রিপিটেশন।
আসলে জীবনের রিপিটেশনকে বোঝার মতো মন যে সেই মানুষগুলোর থাকে না। যে সত্তর-উত্তীর্ণ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, শচীনকর্তার গান- ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসনি, তুমি কি আমায় বন্ধু, কাল ভালোবাসনি’, শুনে আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় কোমর দোলাতে না পারলেও, মনটা দোলাতে পারেন, তিনি কিন্তু জীবনের রূপ-রস-গন্ধকে যথার্থভাবে অনুভব করতে পারেন। উপলব্ধি করতে পারেন।
এভাবেই আমরা স্মরণজিতের সামগ্রিক সৃষ্টিকে বর্ণনা করতে পারি। এখানেই স্মরণজিতের লেখকসত্তার সব থেকে বড় সাফল্য। টিনএজারদের কাছেও যেমন তার লেখা এক ধরনের মনের প্রাণের জিনিস হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনিই আবার জীবন উপান্তে চলে আসা একজন মানুষের কাছেও স্মরণজিৎতের লেখা হয়ে ওঠে মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম।
স্মরণজিৎতের সৃষ্টির আরেকটি বড় উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শব্দের প্রয়োগ। সমসাময়িকতার সঙ্গে এত সাযুজ্যপূর্ণ শব্দ তার লেখায় গাঁথা হয় যে, লেখা পড়লে মনে হয় না আলাদা করে আমরা একটা কিছু দেখছি। আলাদা করে আমরা একটা কিছু পড়ছি। আমাদের মনে হয় যেন, চলমান জীবনের মধ্যদিয়ে একটি আলেখ্য একেবারে যেন স্লাইডের পর স্লাইড হিসেবে লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। যে ভাষায় আমরা কথা বলি, যে ভাষায় আমরা ঝগড়া করি, যে ভাষায় আমরা স্বপ্ন দেখি, যে ভাষায় আমরা কাঁদি, আনন্দ করি, বিষণ্ন হই, রেগে যাই- তার প্রতিটির এত যথার্থ প্রতিফলন- এটা সমসাময়িক বাংলা ভাষায় কথাসাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্রে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী একটি নতুন ধারা সংযোজন করেছেন, একথা বললে মনে হয় না খুব ভুল হবে।
সমসাময়িকতাকে ধরতে পারাই তো একজন লেখকের সব থেকে বড় কৃতিত্ব। আর এ কৃতিত্ব প্রমাণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালের বাংলা সাহিত্যের কথাকারদের মধ্যে স্মরণজিৎ যেভাবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন, তা এক কথায় বিশেষ রকমের উল্লেখের দাবি রাখে। স্মরণজিৎ এপার বাংলায় তার নিজের সমসাময়িক কিছু লেখকের মতো তত্ত্বনির্ভর, জীবনবিমুখ, অভিধান-নির্ভর শব্দাবলির ভারে আকীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করেন না। নিজেকে পণ্ডিত হিসেবে দেখানোর কোনো মন-মানসিকতা স্মরণজিৎতের মধ্যে নেই। তাই তেমন দৃষ্টিভঙ্গি তিনি কখনোই নিজের সৃষ্টির মধ্যে জোর করে চাপিয়ে দেন না। এই যে বৈশিষ্ট্যটা স্মরণজিৎতের লেখার মধ্যদিয়ে ফুটে ওঠে, এটা এপার বাংলায়, নয়ের দশকের লেখক বা যাদের জন্ম সাতের দশকে বা পরবর্তী সময়ে, তাদের প্রায় সবার মধ্যেই দুর্লভ।
এখানেই স্মরণজিৎ একটা বিশেষ ধরনের ব্যতিক্রম। নিজেকে বা নিজের সৃষ্টিকে অহেতুক বিতর্কিত করে তোলে, বইয়ের বিক্রি বাড়ানো বা টিআরপি বাড়ানোর সস্তা পথে স্মরণজিৎ কখনো হাঁটেন না। আর সেই কারণেই হয়তো সমসাময়িক কারও কারও তিনি চক্ষুশূল, তা সত্য! যে কথা বারবার বলতে হয়- সাম্প্রতিককালের বাংলা কথাসাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী ধারার জনক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। যে ব্যতিক্রমী ধারার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- শত দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত জীবন যে মৃত্যুর থেকেও অনেক অনেক বড়, বেঁচে থাকা যে হতাশার থেকে অনেক অনেক ধ্রুব সত্য- তা যেন একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে স্মরণজিৎতের সৃষ্টির মধ্যে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]