গাড়িতে আগুন লাগা একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা, যা মুহূর্তের মধ্যে জীবন ও সম্পদ নষ্ট করতে পারে। সাধারণত বৈদ্যুতিক গোলযোগ, ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হওয়া কিংবা জ্বালানির লিকেজের মতো সমস্যা থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। আসুন জেনে নিই গাড়িতে আগুন লাগার কারণ ও তা প্রতিরোধ করার উপায় যায়।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ
গাড়িতে আগুন লাগার অন্যতম সাধারণ কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। এই সমস্যা মূলত গাড়ির বৈদ্যুতিক সার্কিট বা যন্ত্রাংশের ত্রুটির কারণে দেখা দিতে পারে। গাড়ির বৈদ্যুতিক তারগুলোয় ত্রুটি থাকলে শর্টসার্কিট হতে পারে, যা আগুন লাগার অন্যতম কারণ। বিশেষ করে পুরোনো মডেলের গাড়িতে তারের সংযোগ ঢিলেঢালা হলে বা কোনো তার ক্ষতিগ্রস্ত হলে আগুন ধরার আশঙ্কা থাকে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির তারগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ফলে শর্টসার্কিটের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ছাড়া অপ্রশিক্ষিত কারিগরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ইনস্টল করলে তার সংযোগ ভুল হতে পারে, যা অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি করে। এতে শর্টসার্কিট হয়ে গাড়িতে আগুন ধরতে পারে।
অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ সংযোগ করলে সার্কিটে অতিরিক্ত লোড পড়ে। এতে শর্টসার্কিটের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে চার্জিং পোর্টের ত্রুটি বা প্লাগ ঢিলেঢালা হলে স্পার্ক হতে পারে, যা আগুন ধরানোর জন্য যথেষ্ট।
ব্যাটারির সমস্যা
গাড়িতে আগুন লাগার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি ব্যাটারির সঠিক আকার ও মানের প্রতি নজর না দেওয়া। বৈদ্যুতিক ও জ্বালানিচালিত গাড়িতে ব্যাটারির আকার ও স্থাপনের স্থান সঠিক না হলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
গাড়ির ব্যাটারি যদি সঠিকভাবে ইনস্টল না করা হয়, তবে তা গাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ভুল মাপের ব্যাটারি বা ইঞ্জিনের অনুপযুক্ত স্থানে রাখা ব্যাটারি গাড়ির ভোল্টেজ ভারসাম্য নষ্ট করে। এতে অতিরিক্ত হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা স্পার্কের মাধ্যমে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।
বৈদ্যুতিক গাড়িতে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির ব্যবহারে অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হয়, যা অতিরিক্ত তাপ বিকিরণ ঘটিয়ে আগুন লাগাতে পারে। এ ছাড়া পুরোনো বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাটারি থেকেও রাসায়নিক তরল লিক হয়ে গাড়ির অন্যান্য অংশে আগুন ধরার ঝুঁকি বাড়ায়। ব্যাটারির আকার সঠিক না হলে, তা বিস্ফোরিত হতে পারে। অতিরিক্ত চার্জিংয়ের ফলে ব্যাটারি থেকে গ্যাস নির্গত হয়, যা সহজে জ্বলে উঠতে পারে।
ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হওয়া
গাড়ির ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হওয়া (ওভারহিটিং) গাড়িতে আগুন ধরার অন্যতম প্রধান কারণ। ইঞ্জিনের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে গাড়ির অন্যান্য যন্ত্রাংশে আগুন লাগার ঝুঁকি বাড়ে। এটি একটি সাধারণ সমস্যা হলেও সময়মতো প্রতিকার না করলে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
ইঞ্জিনে পর্যাপ্ত কুল্যান্ট না থাকলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ফলে ইঞ্জিন দ্রুত গরম হয়ে যায়। রেডিয়েটর, ফ্যান বা থার্মোস্ট্যাটে সমস্যা থাকলে কুলিং সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। আবার রেডিয়েটরের সামনে ময়লা জমে গেলে বা বাতাস প্রবাহ বন্ধ হলে ইঞ্জিনের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়ে। বেশি লোড বা লম্বা সময় ধরে ইঞ্জিন চালালে ওভারহিট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ইঞ্জিন ওভারহিট হলে রাবার পাইপ, ওয়্যারিং বা তেলের পাইপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে জ্বালানির লিকেজ হতে পারে, যা স্পার্কের সংস্পর্শে আগুন সৃষ্টি করে।
অতিরিক্ত ভোল্টের হেডলাইট
অনেক সময় গাড়িতে অতিরিক্ত ভোল্টের হেডলাইট লাগানো হয়, যা বৈদ্যুতিক সার্কিটে চাপ ফেলে। এতে করে তার গরম হয়ে আগুন ধরে যেতে পারে।
কুলিং ফ্যান অপরিষ্কার
গাড়ির কুলিং ফ্যান অপরিষ্কার থাকলে তা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। ফলে তৈরি উচ্চ তাপমাত্রায় জমে থাকলে সহজেই আগুন ধরে যেতে পারে।
সিএনজি বা এলপিজি লিকেজ
গাড়িতে সিএনজি বা এলপিজি গ্যাস ব্যবহৃত হলে, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে গ্যাস লিক হতে পারে। এটি স্পার্কের সংস্পর্শে এসে আগুনের সূত্রপাত ঘটাতে পারে।
গাড়িতে আগুন লাগলে করণীয়
গাড়িতে আগুন লাগার পর সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বিপদের মাত্রা অনেক বেড়ে যেতে পারে। তাই গাড়ি চালানোর সময় কিছু জরুরি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন বন্ধ করুন ও গাড়ি থেকে নেমে নিরাপদ দূরত্বে যান। গাড়িতে সবসময় একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখুন এবং তা ব্যবহার করতে শিখুন। জরুরি নম্বরে কল করুন। যত দ্রুত সম্ভব ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশের সাহায্য নিন।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
গাড়ির নিয়মিত চেকআপ করানো অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে ইঞ্জিন, ব্যাটারি ও জ্বালানির লিকেজ পরীক্ষা করুন। গাড়ির জন্য নির্ধারিত আকারের ব্যাটারি ব্যবহার করুন ও ব্যাটারি চার্জিংয়ের সময় সতর্ক থাকুন। গাড়ির কুলিং ফ্যান ও রেডিয়েটর নিয়মিত পরিষ্কার করুন। ইঞ্জিন তাপমাত্রা পরীক্ষা করার জন্য কুল্যান্ট, ইঞ্জিন অয়েল ও রেডিয়েটরের অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
সিএনজি বা এলপিজি গাড়ি ব্যবহার করলে লিকেজ আছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। ভালো মানের সিলিন্ডার ব্যবহার করুন, প্রয়োজনে তা প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানের কাছ থেকে চেকআপ করান। নিম্নমানের তার বা ফিউজ ব্যবহার না করে উচ্চমানের পণ্য ব্যবহার করুন। এটি শর্টসার্কিটের ঝুঁকি কমাবে।
ইঞ্জিন ওভারহিট হলে রাস্তার পাশে থেমে গাড়ি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিন। সমস্যা বেশি হলে নিকটস্থ সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করুন। বৈদ্যুতিক তার ও সংযোগ সঠিক অবস্থায় আছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করুন। অপ্রয়োজনীয় হেডলাইট বা অন্যান্য অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
গাড়ির বৈদ্যুতিক সমস্যা থেকে আগুন লাগার ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গাড়ির বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের সুস্থতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ির কোনো অস্বাভাবিক গন্ধ, ধোঁয়া বা অতিরিক্ত তাপ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
গাড়িতে আগুন লাগার ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতা ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত চেকআপ ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বড় ধরনের বিপদ থেকে বাঁচা সম্ভব। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জরুরি পরিস্থিতিতে সঠিক পদক্ষেপ নিন। স্মার্ট ব্যবস্থাপনায় যেকোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।