পেপারব্যাক বা হার্ড কাভারের বইয়ের পাশাপাশি তরুণ পাঠকদের একটি অংশ এখন ঝুঁকছে ই-বুক আর অডিও বুকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে কাগুজে বইগুলো তারা অবিকল পড়ছেন পিডিএফ বা অডিও ভার্সনে। যারা ছাপা হরফে বই পড়তে নারাজ, সাহিত্যপাঠে তারা বেছে নিচ্ছেন অডিও বুক।
এ বছরের বইমেলায় ই-বুক এবং অডিও বুকের ৫টি স্টল রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী প্রাঙ্গণে রয়েছে ‘কাহিনীক’ অডিও বুক, বাংলা একাডেমিতে রয়েছে ‘কাব্যিক’, ‘শুনো বই’। রকমারি ই-বুক চড়ুই ডটকমের বইঘরও রয়েছে বইমেলায়। এ ছাড়া ই-বুক এবং অডিও বুক-দুটি বিষয় নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বইঘরের স্টলও রয়েছে বইমেলায়।
কাহিনীক অডিও বুকের অন্যতম কর্ণধার ইমরাদ জুলকারনাইন খবরের কাগজকে বলেন, ‘২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করি। যেহেতু আমাদের কাজ অডিও বুক নিয়ে, একজন পাঠক কীভাবে অডিও বই পাঠ করবেন, এ নিয়ে নানা পরিকল্পনা করতে লাগলাম। সাহিত্যের তো রূপ, রস থাকে। এটি কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেই ভাবনা থেকে আমরা নিজস্ব ব্যাকরণ পর্যন্ত তৈরি করলাম, যার মাধ্যমে সৃষ্টি করলাম কীভাবে অডিও একটি বই পড়তে হবে; হয়তো অদূর ভবিষ্যতে এটি লিপিবদ্ধ করাও হতে পারে।
অডিও বুক যেন একেবারে শ্রুতিনাটক হয়ে না যায়, সে ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করছে কাহিনীক। ইমরাদ জুলকারনাইন বলেন, ‘আমরা বইকে শ্রুতিনাটক করতে চাই না, চরিত্র করে নাটক বানানো, একেবারেই নাটক বানানো আমাদের উদ্দেশ্য না। নারী-পুরুষের বিভেদের বিষয়টিও আমরা রাখিনি। যেন একজন অডিও বুক পাঠকও মনে করেন তিনি বই পড়ছেন, আমরা সেটিরই চেষ্টা করছি।’
তিনি জানান, কাহিনীকে ৪০টি বই রয়েছে। এ ছাড়া ৩৫০টি বই অডিও বুক হিসেবে প্রকাশের চুক্তি রয়েছে। মূল বইয়ের তুলনায় অডিও বুক অর্ধেক দামে কেনা যাবে বলে জানান তিনি।
অডিও বইয়ের স্টল শুনো বই- এর বিক্রয় প্রতিনিধি তানজিন আক্তার শিমু ও জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, শুনো বইয়ে এখন তিন শতাধিক বই রয়েছে। তিন হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে তাদের। হরর, থ্রিলার, রোমান্স, অ্যাডভেঞ্চার, মোটিভেশন, ক্লাসিক, রিলিজিয়াস, বায়োগ্রাফি, গল্প, কবিতা, বিশেষ শিশুতোষ বইগুলোই ই-বুক হিসেবে চাহিদার শীর্ষে রয়েছে।
অডিওবুকের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা রয়েছে কাব্যিকের। কাব্যিকের সিটিও অমিত বিশ্বাস জানান, ৯০টির বেশি দেশে কাব্যিকের গ্রাহক রয়েছে। সাড়ে ৭০০ অডিও বুকের পাশাপাশি এ বছর বিভিন্ন বইয়ের অংশবিশেষ নিয়ে আড়াই হাজারের মতো কনটেন্ট রয়েছে। অমিত বলেন, ‘স্বল্প মূল্যে বই আমরা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা করেছি। আমরা মাসিক, অর্ধবার্ষিক এবং বার্ষিক প্যাকেজ রেখেছি। যেন একজন পাঠক একেবারে সব বইয়ের অ্যাকসেস পেয়ে যান। আমাদের সর্বোচ্চ প্যাকেজ বার্ষিক ৪০০ টাকা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একজন পাঠক আমাদের সব বই, পডকাস্টসহ সব কনটেন্ট ১ বছরে অ্যাকসেস করতে পারবেন। আমাদের সব ধরনের বই রয়েছে। তবে ধর্মীয়, আত্ম-উন্নয়নমূলক ও বাংলা ক্লাসিকের পাঠক বেশি।’
নতুন বই প্রকাশের বিষয়ে অমিত বিশ্বাস বলেন, ‘ইচ্ছে করলে নতুন লেখকরা এখান থেকে বই প্রকাশ করতে পারেন। বই প্রকাশের পুরো খরচ কাব্যিক বহন করবে। ভয়েস দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুর খরচ আমাদের। যদি বইটি ভালো সাড়া ফেলে, অবশ্যই লেখকের সঙ্গে আমরা মুনাফা শেয়ার করব।’
ই-বুক এবং অডিও বুক-দুটি দিক নিয়েই কাজ করছে বইঘর। বইঘরের কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ই-বুক এবং অডিও বুক দুটোই রয়েছে। সব মিলিয়ে ১ হাজারের কাছাকাছি হবে। আমাদের বই পড়তে হলে অন্য অডিও এবং ই-বুকের মতো কিছু প্ল্যানও রয়েছে; তবে পাঠক চাইলে প্রতি বই কিনতে পারবে।’
হায়দার মোহাম্মদ জিতুর লেখা ‘তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা: শেখ হাসিনা’ বইটি এনেছে শব্দশৈলী। সংকলিত গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানুষের অনুভূতি হয়ে ওঠার পট চিত্রিত করে, ভবিষ্যৎকে ইঙ্গিত দেয়। বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইস্যু, দেশের উন্নয়ন, অর্জন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতায় দেশের অবস্থান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছুটে চলা উঠে এসেছে বইটির প্রবন্ধগুলোতে।
শেষ শিশুপ্রহরে জমজমাট বইমেলা
গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার ২৩তম দিন। বইমেলার নিয়ম অনুযায়ী ছিল শেষ শিশু প্রহর। শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে শিশু প্রহর। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে বৃষ্টির পানিতে বইমেলা প্রাঙ্গণ বেশ কর্দমাক্ত ছিল। এতে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হলেও প্রিয় বইটি কিনতে খুদে পাঠকদের ঢল নেমেছিল গতকাল সকালে। স্টল থেকে স্টলে ঘুরে রংবেরঙের বই বেশ সময় নিয়ে নিরীক্ষা করলো তারা। পরে বাবা-মায়ের কাছে পছন্দসই বই কিনে দিতে বায়না জুড়ল।
গতকাল সকালে ঢাকার রামপুরা থেকে এসেছিল দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া মাহিন, সঙ্গে ছিলেন তার বাবা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা রাজু আহমেদ। রাজু বলেন, সন্তান যেন ডিভাইস ছেড়ে বইমুখী হয়, তাই প্রতি শুক্রবার তাকে নিয়ে মেলায় আসি। মাহিন বই নেড়ে-চেড়ে দেখছে, দেখুক। এরপর যদি ভালো লাগে সে কিনুক। কেননা, ওই ভালো লাগা থেকে যখন সে বই কিনবে একটা সময় গিয়ে তার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।’ মাহিন জানাল, সে বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কারের মজার গল্পের বই কিনেছে। সে পড়তে ভালোবাসে কমিকস। এমন কিছু বইও কিনেছে সে।
ময়ূরপঙ্খী প্রকাশক মিতিয়া ওসমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছোটদের বই তৈরি অনেক ব্যয়বহুল; এখানে আর চারটে বইয়ের মতো শুধু লেখা থাকে না। এর পাশাপাশি ছবিও থাকে। যার ফলে লেখকের পাশাপাশি একজন আর্টিস্টেরও প্রয়োজন হয়। যখন একজন আর্টিস্ট আঁকবেন সেখানেও তো একটি বাড়তি খরচ হবে। অনেকটা বলতে পারেন, শিশুদের বই তৈরি একটি অনেক বড় বিনিয়োগ। বই তৈরিতে মূল্যবৃদ্ধিও একটি কারণ হতে পারে।’
মেলার নতুন বই
শনিবার বইমেলায় নতুন বইয়ের স্টলে জমা পড়েছে ১৩৮টি বই। এর মধ্যে দ্বিমত প্রকাশনী থেকে এসেছে খোকন দাসের বই ‘পাহাড় ও সমতলের গল্প’। এদিকে বই মেলায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে ‘মাদকের সাতসতেরো’ ও ‘কিশোর গ্যাং- কীভাবে এলো, কীভাবে রুখবো’ বই দুটি। কর্মক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সচেতনতামূলক বই ২টি লিখেছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। গতকাল শনিবার কমান্ডার খন্দকার আল মঈন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বই দুটি এবার মেলায় ব্যাপক সারা পাচ্ছে। পাঠকেরা আমাকে খুব আশ্বস্ত করছে এবং বইটি কিনছে বলে জানাচ্ছেন।’
মেলার নানা আয়োজন
শনিবার বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণ: মোহাম্মদ রফিক এবং স্মরণ : খালেক বিন জয়েনউদদীন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যথাক্রমে আলতাফ শাহনেওয়াজ এবং সুজন বড়ুয়া। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শামীম রেজা, শোয়াইব জিবরান এবং আসলাম সানী। সভাপতিত্ব করেন আবুল মোমেন।
প্রাবন্ধিক বলেন, কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতার মধ্যে স্মৃতির ভাগই বেশি। স্মৃতি আর কবির চারপাশের সত্তা তার কবিতায় মিলেমিশে আছে।
তারুণ্যের প্রথম প্রহরে বামপন্থি রাজনৈতিক সক্রিয়তা আর কৈশোরে সংঘটিত দেশভাগ এবং দেশভাগের ফলে ভিটামাটি তথা দেশ ছেড়ে মানুষের দেশান্তরি বা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনার মধ্যে যে বেদনাবোধ নিহিত, সেই বেদনাতুর স্মৃতিই তাকে কবিতা রচনায় প্রেরণা দিয়েছে।
অন্যদিকে যে কজন শিশুসাহিত্যিক প্রতিভার দীপ্ত আলোয় আমাদের শিশুসাহিত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন, খালেক বিন জয়েনউদদীন তাদের মধ্যে অন্যতম। মূলত শিশুসাহিত্যিক হলেও তিনি জীবনী-প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি রচনার ক্ষেত্রেও রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। লোকসাহিত্যের ঐতিহ্যকে ধারণ করে খালেক বিন জয়েনউদদীন গড়ে তুলেছেন ছড়ার আধুনিক অবয়ব।
সভাপতির বক্তব্যে আবুল মোমেন বলেন, কবি মোহাম্মদ রফিক এবং ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক খালেক বিন জয়েনউদদীন তাদের সাহিত্যপ্রতিভা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে তারা এই দেশ ও গণমানুষের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পালনের চেষ্টা করেছেন। নতুন প্রজন্মের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা ও ইতিবাচক মনোগঠনে তাদের সাহিত্যকর্ম অপরিসীম ভূমিকা রাখবে।
শনিবার লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও গবেষক শাহনাজ পারভীন, কবি ও অনুবাদক সাইফুল ভূঁইয়া, কথাসাহিত্যিক শাহনাজ পারভীন স্মৃতি এবং গবেষক মনিরুজ্জামান শাহীন।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজনে গতকাল মুহম্মদ মোজাম্মেল হক রচিত মুক্তিযুদ্ধ ও আলোকচিত্র বই বিষয়ে লেখকের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।