যখন যেটা করি সেটাই ভালো লাগে আমার। আমার সমস্যাটা ওখানেই। একবার যখন লেখা শুরু করলাম, তখন লিখতে ভালো লাগে। কী লিখি, না লিখি সেটা তো বলতে পারব না। এটা এমন ক্লাসিক কিছু না বা সাংঘাতিক কিছু না, কিন্তু আমি লিখি। আমার ভালো লাগে। আমার পাঠকও কিছু আছেন, যারা আমার বই পড়েন। তারা ইন্সপায়ার করেন, আর এ কারণে লেখাটা হয়ে যায়।
আমার যে ভাবনা হয়, মনে হয় আচ্ছা, এগুলো লিখে ফেললেই তো ভালো হয়। আগে এ কারণেই কলাম লিখতাম। কলামের লেখাগুলো নিয়ে আমার চারটা বই আছে। ওই বইগুলো নিয়ে মানুষের সাংঘাতিক চাহিদা ছিল। তখন থেকেই মনে হয়েছে, আচ্ছা লিখিই না। যাদের ভালো লাগবে তারা পড়বে, যাদের ভালো লাগবে না, পড়বে না।
নাটক তো সেই ছোটবেলা থেকেই করি, আমার মজ্জার ভেতরে নাটক, আমার রক্তের ভেতরেও নাটক। সবকিছুর ভেতরেই আমার নাটক। অভিনয় করতে করতে একসময় লেখালেখি শুরু করলাম। শুধু একটা জিনিসই ভালো লাগে না, সেটা হচ্ছে চাকরি করা। এ কারণে চাকরি করা বহু আগেই ছেড়ে দিয়েছি। প্রথমে সরকারি চাকরি ছাড়লাম। তারপর প্রাইভেট চাকরি ছাড়লাম। কনসালট্যান্সি করেছি। সেটাও ছেড়ে দিয়েছি একসময়। চাকরিকে গোলামি মনে হয়।
প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্যই ক্রিয়েটিভিটি লাগে। যে নাটক করে, তার একধরনের ক্রিয়েটিভিটি, যে ছবি আঁকে, তার আরেক ধরনের ক্রিয়েটিভিটি লাগে। গান যারা গায়, যারা ছবি আঁকে, এই দুই ধরনের মানুষকে আমি ভীষণ ঈর্ষা করি। যারা এই দুটা বিষয় করতে পারে, তাদের আমার এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট মনে হয়। অভিনয় বিষয়টা আস্তে আস্তে মানুষ শিখে যায়। আল্লাহ প্রদত্ত কিছু গুণ অবশ্যই থাকে, কিন্তু প্র্যাকটিস করতে করতে একসময় ভালো অভিনেতা হয়ে যেতে পারে। লিখতে লিখতে অনেকে ভালো লেখে।
অনেকেই কবিতা লেখে বা তাদের কথা বলতে পারে, কিন্তু ভেতরের কিছু কথা থাকে, যেটা কেউ কেউ খুব গভীরভাবে বলতে পারে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সত্যেন্দ্রনাথ বাদ দিলাম, আমাদের এখানে অনেক কবি আছেন, যারা অত্যন্ত ভালো লেখেন। তাদের কয়েকটা লাইন পড়লেই বোঝা যায়, তারা কত গভীরে যেতে পারেন। কেউ কেউ ছন্দ মিলিয়ে আবার কেউ কেউ ছন্দ না মিলিয়েও লেখেন। ভালো লিখতে হলে এ ধরনের ব্রেইন তো অবশ্যই লাগবে।
আমি খুব বেশি বইমেলায় আসি না। কাজের ব্যস্ততার সঙ্গে এই সময়টা মেলে না। এবার আমি একটু ফ্রি ছিলাম, এই নিয়ে দুই দিন এলাম। গত বছরও এসেছিলাম। গত বছরের চেয়ে এবার লোক বেশি, চাকচিক্যও বেশি, জাঁকজমকও বেশি, বিস্তৃতি বেশি, দর্শকও বেশি। সেই সঙ্গে বই না কেনার দর্শকও বেশি। এটা আমি দেখে বুঝছি। এখানে বসে আছি প্রায় ২ ঘণ্টা হয়ে গেল। দেখছি, মানুষ খালি ঘুরছে। বাচ্চা নিয়ে আসছে, ঘুরছে, বইয়ের দোকানে দাঁড়াচ্ছে। চলে যাচ্ছে। তবে বই একেবারেই বিক্রি হচ্ছে না, এটা বোধহয় ঠিক কথা না। বই বিক্রি হচ্ছে।
বই পড়া আসলেই কমে যাচ্ছে কি না, সেটা বলতে পারব না। নাট্যজগতের অনেককেই দেখেছি, তাদের মধ্যে বইপত্র পড়ার উৎসাহ কম। আমরা একটা বই পেলে পাগলের মতো পড়তাম। এখন সেই ক্রেজ দেখি না। আগে আমরা বই পড়তাম, বই নিয়ে আলোচনা করতাম, গল্প করতাম কে কোন বই পড়েছে। সেটা নিয়ে পোস্টমর্টেম করতাম। কিন্তু এখন তো সে রকম আলোচনা হতে দেখি না আর। তার মানে, এখন বই পড়ার লোক অনেক কম।
ডিজিটাল জগতে এসে আপনি আশা করতে পারেন না যে মোবাইল ফেলে দিয়ে আমি সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকব। কিন্তু যাদের মধ্যে ওই ক্রেজটা আছে যে আমি বই পড়ব, তারা ঠিকই পড়ে। বই পড়ার মধ্যে একটা আলাদা মজা আছে। সেই মজাটা যারা উপভোগ করতে পেরেছে, তারা বই কেনে।
আমরা আগে যেকোনো উৎসবে বাচ্চাদের বই উপহার দিয়েছি। জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস, ঈদসহ প্রত্যেকটা উৎসবে আমরা বাচ্চাদের বই উপহার দিয়েছি। এখন সেটা করে বলে তো আমার মনে হয় না। আর বই বিক্রি হয় কোথায়? বই বিক্রি হয় সরকারি লাইব্রেরিতে, সরকারি কলেজে, সরকারি ইউনিভার্সিটিতে। বছরে এত হাজার টাকার বই কিনতে হবে, এখানে এসে লট বেঁধে নিয়ে চলে গেল। এভাবেই তো বই বিক্রি হচ্ছে। কয়টা পাঠক বই কেনে? কিনলেও খুবই কম।
অভিনেতা, নাট্যকার
অনুলিখন: চন্দনা বিশ্বাস