
গতকাল শুক্রবার ছিল বইমেলার সপ্তম দিন। ‘মেলায় যাইরে… মেলায় যাইরে… / লেগেছে রমণীর খোঁপাতে/ বেলি ফুলের মালা/ বিদেশি সুগন্ধি মেখে আজ প্রেমের কথা বলা/ বাসন্তী-রং শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়।’ বেলি ফুলের মালা এ সময়ে দুর্লভ। কিন্তু গতকাল মেলায় অন্য নানা মৌসুমি ফুলে সাজুগুজু করা বাসন্তী-রং শাড়ি পরা ললনাদের দেখা পেয়েছি। সেই সঙ্গে উৎসবের পোশাকে পুরুষ-শিশু-প্রৌঢ় মানুষের দেখা মিলেছে। সবাই ছিলেন উৎসবের মেজাজে। পাঠতৃষ্ণার্ত পাঠকের সংখ্যাও ছিল উল্লেখ করার মতো। এটা আমার অনুমান নয়, প্রকাশকদের ভাষ্য।
আগেই ঠিক ছিল, খবরের কাগজের সম্পাদক কথাশিল্পী মোস্তফা কামাল মেলায় যাবেন। সঙ্গী হব আমি, খবরের কাগজের নির্বাহী সম্পাদক এনাম আবেদীন আর ইভেন্ট ব্যবস্থাপক আতিয়া সুলতানা। কিন্তু পথে নেমেই গত বৃহস্পতিবারের মতোই অবস্থা হলো। শাহবাগের চারদিক ঘিরে যানজট। প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রভাবে এই দুর্দশা।
কিছুটা হেঁটে দোয়েল চত্বর দিয়ে মেলায় ঢুকতেই মেলার মেজাজ বোঝা গেল। লোকে লোকারণ্য। প্রথম লক্ষ্য ছিল বাংলা একাডেমি প্রান্তের ‘খবরের কাগজে’র স্টল। সময় বিকেল পাঁচটা। বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে তখন সেমিনার চলছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে খুব বেশি জনসমাগম চোখে পড়েনি। আসলে এই এলাকায় প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, সেবামূলক বা মিডিয়াকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি শাখারও স্টল থাকে। এবারও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। গতকালও ওদিকটাতে লোকজনের আগমন তাই তেমন একটা চোখে পড়েনি।
লেখক মোস্তফা কামাল বইমেলা নিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চমৎকার কিছু কথা বললেন। ‘বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। সর্বজনীন মেলা। এখানে অনেকে দর্শক হিসেবে আসেন। বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়। মেলা তো এমনই হয়। এর মাঝেই মানুষ বই কিনছে। পাঠক যদি মননশীল ও সৃজনশীল হয় তাহলে আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে, মানুষে মানুষে যে হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যায়, সেসব কমবে। বই এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে।’
মেলার মূলকেন্দ্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেখানে যখন আমরা চারজন পৌঁছুলাম, তখন সন্ধে ছয়টা। থইথই করছে মানুষ। গণসমাবেশের চেয়েও লোকসমাগম বেশি। এ রকমটাই হওয়া স্বাভাবিক। বইমেলার প্রথম শুক্রবার। এবার লেখক মোস্তফা কামালের পাঁচটি নতুন বই বেরিয়েছে অনন্যা থেকে। বইগুলো হচ্ছে ‘পারমিতার সুখ-দুঃখ’, ‘কবি ও একজন নর্তকী’, ‘ফটকুমামা গোয়েন্দাসমগ্র-২’, ‘ফার্স্ট বয়’ এবং ‘গুপ্তধন ও অপু’। এই শেষের বইটিই কিনছিল খুদে পাঠক ওয়াসিফ। সে বাবা-মা ও বোনের সঙ্গে রাজশাহী থেকে মেলায় এসেছে। ওয়াসিফের বাবা এম এ বশির রাজশাহী কলেজের লাইব্রেরিয়ান। প্রতিবছর তিনি সন্তানদের নিয়ে রাজশাহী থেকে বইমেলায় আসেন। পুত্রের বই পড়ার আবদার মেটান সানন্দে। ওয়াসিফ লেখক মোস্তফা কামালের অটোগ্রাফ নিল। দেখলাম সে আরও দুটি বই কিনল- মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘ত্রিনিতি রাশিমালা’ ও ‘বিজ্ঞানী সাফকাত আলীর আজব আজব আবিষ্কার’। অনন্যা এবার ব্যতিক্রমী দু-তিনটি বই প্রকাশ করেছে। গতকাল সেই বইয়ের একটি ‘দ্রোহের গ্রাফিতি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’ মেলায় এনেছে তারা। এই বইটি রয়্যাল সাইজে চার রঙে ছাপা। গ্রাফিতির ছবি দিয়ে সাজানো। ছবিগুলো তুলেছেন রাজিব হোসেন। তিনিই বইটির স্বত্বাধিকারী।
অনন্যাতেই দেখা হয়ে গেল অন্বয় প্রকাশের হুমায়ুন কবির ঢালির সঙ্গে। ঢালি নিজে শিশুসাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের বই প্রকাশ করেন। এবার অন্বয় মেলায় এনেছে ৫টি বই। ঢালি বললেন, ‘বইমেলার অবস্থা আগের মতো রমরমা নেই। স্টলের সংখ্যা বেশি বলে লোকজন ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তেমন জনপ্রিয় লেখকও নেই। তরুণ লেখকরা এখন ওয়ানটাইম লেখক। একটা বই বের করল তো শেষ। আর সেই লেখককে খুঁজে পাওয়া যায় না। মৌসুমি লেখক বলা যায় এদের। এর অবশ্য একটা ইতিবাচক দিক আমি দেখছি।’ ঢালি বললেন, ‘নতুন ভালো বইয়ের অভাবে জনপ্রিয় ক্লাসিক বা চিরায়ত বইয়ের প্রতি একশ্রেণির পাঠকের আগ্রহ বাড়ছে। এখন আর আগের মতো নির্দিষ্ট কোনো লেখককে কেন্দ্র করে বই পাচ্ছে না পাঠক। এ রকম কোনো লেখকের কথা আপনি বলতে পারবেন না।’ তবু এর মাঝে অনন্যার বিক্রি ভালো হচ্ছিল গতকাল। জানালেন অনন্যার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হক।
অনন্যা থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লাম সময় প্রকাশনের প্যাভিলিয়নে। অনন্যার মতোই সময়ের প্যাভিলিয়ন ঘিরে পাঠকদের ভিড়। লেখক মোস্তফা কামাল উপস্থিত হয়েছেন। উপস্থিত প্রকাশক ফরিদ আহমেদ, এনাম আবেদীন, আমি ও অভিনেতা ডা. এজাজ। হুমায়ূন আহমদের নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতিমান এজাজের তিনটি বই বেরিয়েছে মেলায়। সবগুলোই হুমায়ূন আহমদকে নিয়ে লেখা। ডা. এজাজকে রসিকতা করে বললাম, ‘আপনি তো তিন শ টাকার ডাক্তার। আপনার কাছে আমাকে নিয়মিত যেতে হবে চিকিৎসা করাতে।’ তিনি স্মিত হাসলেন। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল হুমায়ূন আহমদের লেখাই তাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করেছে। লিখেছেনও হুমায়ূন আহমদকে নিয়ে। সবই স্মৃতিচারণা। আরও অনেক কথা হলো তার সঙ্গে। সেই কথাগুলো আপনারা আমার গ্রহণ করা ভিডিও সাক্ষাৎকারে শুনতে পারবেন। ভিডিওটি খবরের কাগজের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে (ফেসবুক) আপলোড করা হবে। আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
আগের দিন অবরোধের প্রভাবে মেলা থেকে বেরিয়েছিলাম অনেকটা নির্ভার হয়ে। লোকসমাগম তেমন ছিল না। ভিড়ও ছিল না। কিন্তু গতকাল রীতিমতো জনসমুদ্র ঠেলে যেমন মেলায় ঢুকেছিলাম, তেমনি জনস্রোতের সঙ্গে মেলা থেকে বেরোতে রীতিমতো বেগ পেতে হলো।
আজ শনিবার। আরেকটি ছুটির দিন। আমি নিশ্চিত আজও মেলায় মানুষের ঢল নামবে। পাঠক কত শতাংশ থাকবে বলা মুশকিল। এ নিয়ে একটা জরিপ হতে পারে। কিন্তু আজ এই ত্রিশ বছরেও বইমেলা নিয়ে এ রকম কোনো জরিপ হয়নি। এত এত জরিপ হয়, বইমেলা নিয়ে হয় না কেন? তাহলে অন্তত বোঝা যেত আমাদের পাঠাভ্যাস কেমন। কী ধরনের পাঠক আসেন। কী ধরনের বই তারা কেনেন।