
বইমেলায় গতকালও ছুটির আমেজ ছিল। বই কেনার চাইতে বইমেলাকে উপভোগ করাই যেন ছিল সবার লক্ষ্য। প্রিয়সান্নিধ্যে মেলায় ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে! গতকাল মেলায় ঢুকে বিদ্যাপ্রকাশের সামনে এ রকমই মাঝবয়সী এক দম্পতিকে পেয়ে গেলাম, যারা প্রতিবছর মেলায় আসেন। মেলায় না এলে ফেব্রুয়ারির দিনগুলো তাদের শূন্য-শূন্য লাগে। আবু তাহের নামের স্বামীপ্রবর একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। স্ত্রী রোমেনা বেগম স্কুলশিক্ষক। মেলায় এসেছেন কলাবাগান থেকে। ‘কী বই কিনলেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে আবু তাহের বললেন, ‘আমি ইতিহাসের বই পছন্দ করি। ইতিহাসের ছাত্র ছিলাম। ইউপিএল থেকে ভেলাম ভান সেন্দেলের বাংলাদেশ জনপদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বইটি কিনেছি। আগে এটি ইংরেজিতে পড়েছি, আজ নিলাম বাংলায় অনূদিত বইটি।’ স্ত্রীও পড়েন। তিনি খুঁজছেন শিশুদের শিক্ষামূলক বই। স্ত্রীর পড়াকে স্বামী ভীষণভাবে উৎসাহিত করেন। এ জন্যই বইমেলায় প্রতিবার তারা একসঙ্গে একাধিক দিন আসেন।
বইমেলায় একসঙ্গে পেয়ে গেলাম পঞ্চ সখীকে। তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেলফি তুলছিলেন। আমি তখন বাতিঘর প্রকাশনীর সামনে। বাতিঘর একটি ভিন্ন ঘরানার প্যাভিলিয়ন করেছে এবার। দৃষ্টিনন্দন, সেই সঙ্গে আলোছায়ার খেলা দেখা গেল ভেতরে ও বাইরে। ওই পাঁচ সখী সেলফির পাশাপাশি বাতিঘরের প্যাভিলিয়নকে পেছনে রেখে পরস্পরের ছবি তুলছিলেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কী পরস্পরের বন্ধু?’ প্রশ্ন শুনে এক সখী বললেন, ‘হ্যাঁ’। পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘বই কিনলেন?’ উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’ ‘কী বই?’ ‘হুমায়ূন আহমেদের বই।’ মনে মনে ভাবলাম, হুমায়ূন আহমেদ এখনো পুরোনো হননি। এখনো তিনি এই পাঁচ সখীর প্রিয় লেখক। হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই মেলায় আর পাওয়া যায় না বলে আক্ষেপ ঝরে পড়ল তাদের কণ্ঠে। আগে সংগ্রহ করা হুমায়ূনের বই এখনো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়েন তারা, অর্থাৎ পুনর্পাঠ। পঞ্চসখী থাকেন বনশ্রী। পড়েন বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজনের নাম জানা গেল- তানিয়া। বইমেলা তাদের কাছে সুন্দর বেড়ানোর জায়গা। গতকাল এসেছেন, এরপর আসবেন আরও কয়েক দিন একসঙ্গে।
কয়েকটা প্যাভিলিয়ন আর স্টলের সামনে দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ কানে এল পুরুষ কণ্ঠ, ‘এই তুমি হাত ধরো।’ প্রাণস্পন্দনে চঞ্চল এক তরুণ আর তরুণী। মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরল। এ রকম হাত ধরে চলা অনেককেই প্রতিদিন দেখি মেলায়। কখনো কখনো ভিড় না থাকলে পাশাপাশি হাঁটেন। কখনো মেয়েটিকে সামনে দিয়ে ছেলেটি পেছন থেকে আগলে চলেন। অন্য কোনো মানুষের শরীরের সংস্পর্শে যেন না আসে মেয়েটি। দুজনের কারও হাতে বইয়ের প্যাকেট দেখলাম না। এমনভাবে হাঁটছেন যেন বইমেলা হচ্ছে স্রেফ বেড়ানোর জায়গা।
‘বিদ্যাপ্রকাশ’ আমাদের অনেক পুরোনো অভিজাত প্রকাশনী। এই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান খোকা। তিনি আমেরিকা প্রবাসী। কিন্তু দেশে তার প্রকাশনী বেশ ভালোই চলছে। প্রতিবছরই বেশ ভালো ভালো বই প্রকাশ করেন। ঢাকায় তার আগমন ঘটেছে কি না, জিজ্ঞেস করতেই কর্মীরা জানালেন তিনি বিমানে উঠেছেন। আছেন আকাশপথে। এবার বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বেরিয়েছে সদ্য বাংলা একাডেমি রাবেয়া খাতুন পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাশিল্পী সুমন মজুমদারের ‘ঘোড়াগুলা ঘুমাবে’ নামের ছোটগল্পের বই। এতে স্থান পেয়েছে ১২টি গল্প। সুমনের গল্পের মেজাজ অন্যরকম। এই সময়ের মেধাবী কথাশিল্পী সুমন।
বিদ্যাপ্রকাশ এনেছে নাসরীন জাহানের নতুন ছোটগল্পের বই ‘বখতিয়ারের বানরগুলি’। পাঠক, আপনাদের কি আল মাহমুদের সেই কবিতার বইটির কথা মনে আছে- ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’? সেই ‘ঘোড়া’র পর এবার নাসরীন নিয়ে এলেন ‘বানর’। বইটি আমি পড়ব, আপনারও পড়তে পারেন। প্রায় পাঁচ বছর পর নাসরীনের গল্পের বই বের হলো। সেই আকর্ষণেই পড়ব এই বইয়ের ১০টি গল্প। নাসরীনের সঙ্গে কথা হলো। গতকালই তিনি প্রথম বইমেলায় এসেছেন, নিজের নতুন বই আর বইমেলার টানে। আমাকে নতুন বইয়ের একটা কপি উপহার দিলেন। তাতে লিখলেন, ‘কবি মাসুদুজ্জামান, প্রিয়-প্রিয় মাসুদ ভাই। শুভকামনা।’ নাসরীনের সঙ্গে পরে এক দিন জম্পেশ আড্ডা দেব বলে জানিয়ে দিলাম। বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বিশিষ্ট কথাশিল্পী মোহিত কামালের গল্পের বই বেরিয়েছে- ‘শ্রেষ্ঠগল্প’। চমৎকার সংকলন। মোহিত কামাল মেলায় এই বিদ্যাপ্রকাশের স্টলেই আড্ডা দেন। মুখোমুখি হন পাঠকদের। গতকালও তিনি পাঠকদের অটোগ্রাফ দিয়ে নিজের বই তুলে দিচ্ছিলেন। এক দিন ওর সঙ্গেও কথা বলব। অনেক কথা, বইমেলা নিয়ে, ওর লেখালেখি নিয়ে।
বিদ্যাপ্রকাশের ঠিক পেছনেই একটি স্টলের দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম, শিল্পতরু। শিল্পতরু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার প্রিয় বন্ধু সত্তর দশকের শীর্ষকবি আবিদ আজাদ। কাঁঠালবাগানে ছিল শিল্পতরুর কার্যালয়। প্রয়াত আবিদ আর আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদনা করতেন ‘শিল্পতরু’ নামের একটি চমৎকার পত্রিকা। কতদিন যে আড্ডা দিয়েছি আবিদের শিল্পতরুর অফিসে। চকিতে সেই স্মৃতি এসে ভর করল। ‘পত্রিকা তো বের হয় না। কিন্তু কে চালান প্রকাশনীটি?’ স্টলের দুজন কর্মী। শিল্পতরুর ব্যবস্থাপনায় তারাই আছেন। আহসান হাবীব খোকন ও সাইফুল ইসলাম। খোকনই বললেন, ‘আবিদের ছেলে তাইমুর রশিদ এখন এই প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী। পিতার প্রকাশনীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তবে স্টলে প্রদর্শিত বইগুলো দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। বেশির ভাগই অপরিচিত নতুন লেখকদের বই। আবিদের নিজের বইও দেখলাম না। ২০০৫ সালে আবিদের মৃত্যুর পর ইতোমধ্যে তারা প্রায় ৪০০ বই বের করেছে। কম ব্যাপার নয়। এবারও ১৮টি নতুন বই আনবে শিল্পতরু।
নতুন বইয়ের খোঁজ করতে করতে যখন এগোচ্ছি, তখন বাংলা একাডেমির মাইক্রোফোন থেকে ভেসে এল একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের কথা। বইটির নাম ‘কবিতা এবং একটি নক্ষত্র’, লেখক নুসরাত হাশেমী। বের হওয়ার পথটাতে বাংলা একাডেমির ‘লেখক মঞ্চ’। সেখানে পাঠকদের মুখোমুখি হয়েছেন কবি জব্বার আল নাঈম। এবার তার একটি কবিতার বই বেরিয়েছে সাহস পাবলিকেশন্স থেকে ‘আত্মার আওয়াজ’। নাঈমের কাছে সঞ্চালকের প্রশ্ন: ‘এই যে গণ-আন্দোলন হয়ে গেল, তাতে কি আমাদের সাহিত্যের কোনো পরিবর্তন হবে বলে আপনি মনে করেন?’ জব্বার: ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। নতুন ধরনের লেখা পাব আমরা। ইতোমধ্যে কিছু পেয়েছি। ভবিষ্যতে আরও হয়তো পাওয়া যাবে। এবারকার বইমেলাকে বলতে পারেন, পালাবদলের বইমেলা।’