জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি নিয়ে মাসজুড়ে যে বইমেলার আয়োজন করেছিল বাংলা একাডেমি; শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে অনাড়ম্বর এক সমাপনী অনুষ্ঠানে তার পর্দা নামল। বাংলা কথাসাহিত্যের সব ধারার লেখক, কবি, সাহিত্যিক ও প্রকাশকদের মিলনমেলায় শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেমেছিল পাঠকের ঢল।
তবে যে উদ্দেশ্যে বইমেলার আয়োজন, তা কতটা পূরণ হয়েছে এ নিয়ে বহু প্রশ্ন অমীমাংসিত থেকে গেছে বইমেলার শেষ বেলাতেও। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবার অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করতে হয়েছে বাংলা একাডেমিকে। গত জানুয়ারির শেষভাগে বইমেলার প্রস্তুতিপর্বে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির (বাপুস) নেতাদের দ্বন্দ্বে বাংলা একাডেমিকে বেশ হ্যাঁপা পোহাতে হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ব্যানারে একদল প্রকাশক আলাদা হয়ে যান। ‘আওয়ামী লীগ সমর্থক’ তকমা দিয়ে অনেক প্রকাশককে শুরুতে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার হুমকি আসে তাদের তরফ থেকে। তবে বাংলা একাডেমির বইমেলা পরিচালনা কমিটি মুনশিয়ানা দেখায় এ ক্ষেত্রে। বইমেলায় প্রভাবশালী লেখকদের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছে তারা।
আলোচিত, সমালোচিত লেখক তসলিমা নাসরীনের বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে মেলায় সব্যসাচী প্রকাশনার স্টল ভাঙচুর ও পরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা বইমেলার শেষ দিনেও আলোচনার খোরাক জুগিয়েছিল লেখক, প্রকাশকদের আড্ডায়। তবে বইমেলার সমাপনী আয়োজনে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘বইমেলায় ভিন্ন মত ও পথের লেখকদের সম্মিলন ঘটাতে হবে। তরুণ লেখকদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।’
শেষ বিকেলে জনস্রোত
শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে বইমেলার দুয়ার উন্মুক্ত থাকলেও বইমেলার মূল জনস্রোতের দেখা মেলে বিকেল ৫টার পরে। মেলার সব প্রবেশপথেই ছিল উপচেপড়া ভিড়। শেষ বেলায় প্রিয় বইয়ের খোঁজে মেলায় এসেছিল সব বয়সী পাঠক।
রাজধানীর শেওড়াপাড়া থেকে সস্ত্রীক মেলায় এসেছিলেন নাট্যকর্মী পাভেল রহমান। তিনি বলেন, ‘চাকরির ফাঁকে ফুরসত মেলেনি বইমেলায় আসার। আর শেষ দিনে এসেছি, কারণ প্রিয় লেখকদের সব বই এদিন এসে যায়। সব বই কিনতে পারব না। তথ্য সংগ্রহ করে রাখব। কিছু দিনের মধ্যে বইগুলো সংগ্রহ করব।
বইমেলার দর্শকরা কেবল ছবি তুলতে আসেন- প্রকাশকরা পুরো মাসজুড়ে এমন অভিযোগ করে এসেছেন। তবে বইমেলার শেষদিনের বিকেলে এসে তাদের মুখে কিছুটা হাসি ফুটেছে।’
বাতিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বলেন, ‘গতবারের বিক্রির তুলনায় এবার ১০ শতাংশ কম হয়েছে। তবে শেষ বিকেলে তুলনামূলক ভালো ছিল। পাঠকরা শুধু সেলফি তুলতে নন, আজ বিকেলে বইও কিনেছেন বিস্তর।’
বিদ্যাপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মজিবুর রহমান খোকা বলেন, ‘মাসজুড়ে মন্দাই গেছে বইমেলার। তবে শেষদিনে কিছুটা বিক্রি বেড়েছে। তরুণরা মানসম্মত বইয়ের খোঁজ করেছেন। তরুণ লেখকের বই নিয়েও বেশ আগ্রহ ছিল।’
অমর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী অমর সাহা বলেন, ‘এক ইউনিটের স্টল পাওয়া প্রকাশকদের বিক্রি হয়েছে খুব কম। বলতে গেলে মেলায় যত টাকা লগ্নি হয়েছে, তার সিকিভাগও তুলতে পারিনি আমরা।’
বিতর্কে যুক্ত নয় মেলা কমিটি, দাবি মহাপরিচালকের
বইমেলার নানা ঘটনায় প্রকাশক, লেখকদের জড়িয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হলেও তার দায় নিতে নারাজ বাংলা একাডেমি। গতকাল বিকেলে বাংলা একাডেমির মূল মঞ্চে বইমেলার সমাপনী আয়োজনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘মেলাজুড়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে, যার সঙ্গে বাংলা একাডেমি ও বইমেলা পরিচালনা কমিটি সংশ্লিষ্ট নয়। তবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পক্ষের সহায়তায় আমরা সমাধান করতে চেষ্টা করেছি।’
মেলার অব্যবস্থাপনা নিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ড্রিমার ডাংকির সঙ্গেও মতানৈক্য হয়েছে বলে জানান তিনি।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, ‘এমন একটা পরিস্থিতিতে এবার বইমেলা আয়োজন করতে হয়েছে, যখন দেশে পুলিশ নেই; ব্যুরোক্রেসি ফাংশন করছে না। সংস্কৃতির ট্রেনটা লাইনে তুলতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে। আমার মনে হয়, সেটি এখন ঠিক লাইনে চলছে।’
বইমেলা পরিচালনায় নতুন পদ্ধতি প্রচলনে গুরুত্বারোপ করেন তিনি। প্রতিবছর বইমেলায় সেরা বইগুলোর জন্য বাংলা একাডেমি থেকে বিশেষ পুরস্কার প্রবর্তনের কথাও বলেন তিনি।
মেলায় এসেছে ৩২৯৯টি নতুন বই
সমাপনী আয়োজনে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব সরকার আমিন জানান, এ বছর বইমেলায় ৩ হাজার ২৯৯টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির নতুন বইয়ের স্টলে জমা পড়া নতুন বইয়ের সংখ্যা থেকে তিনি এ তথ্য জানান। তবে প্রকাশক সমিতির তথ্য বলছে, প্রকৃতপক্ষে নতুন বইয়ের সংখ্যা এর দ্বিগুণ বা আড়াইগুণ হবে।
সরকার আমিন জানান, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯৩ টাকার বই বিক্রি করেছে।
সমাপনী আয়োজনে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্ব) মো. মফিদুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
বইমেলার সমাপনী আয়োজনে কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫ এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমির ‘কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫’-এ ভূষিত হয়েছেন কবি আল মুজাহিদী এবং ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪’-এ ভূষিত হয়েছেন জার্মান অধ্যাপক হান্স হার্ডার ও কথাশিল্পী বর্ণালী সাহা। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের পুরস্কারের অর্থ, সম্মাননাপত্র ও সম্মাননা-স্মারক দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ২০২৪ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিকসংখ্যক বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কথাপ্রকাশকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৫ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঠক সমাবেশ (প্লেটো : জীবন ও দর্শন/আমিনুল ইসলাম ভুইয়া), ঐতিহ্য (ভাষাশহিদ আবুল বরকত : নেপথ্য-কথা/ বদরুদ্দোজা হারুন) এবং কথাপ্রকাশকে (গোরস্তানের পদ্য : স্মৃতি ও জীবনস্বপ্ন/ সিরাজ সালেকীন) মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ দেওয়া হয়।
২০২৪ সালে গুণমান বিচারে সর্বাধিকসংখ্যক শিশুতোষ বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কাকাতুয়াকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ দেওয়া হয়।