
২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে বইমেলায় কোনো দিনই বইয়ের মেলা থাকে না। হয়ে ওঠে উৎসব। ৪০ বছর ধরে এটা দেখে আসছি। গতকালও তাই একুশের দিনে বইমেলা উৎসবে-উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে উঠেছিল। মুখর না বলে বলা ভালো রীতিমতো জনসমুদ্রে রূপ নিয়েছিল। গতকাল মেলায় দুই ধরনের মানুষ দেখেছি। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীকে নিয়ে, অর্থাৎ সপরিবারে এসেছেন একশ্রেণির মানুষ। আরেক শ্রেণির মানুষ, যারা টিনএজার, দল বেঁধে মেলায় ঘুরতে এসেছেন। দুজন-তিনজন-পাঁচজন করে। এই দুই শ্রেণির কেউই বই কেনেননি। কেনায় কোনো উৎসাহ বা আগ্রহ ছিল না। লক্ষ্যও ছিল না। এরা কেউই আসলে পাঠক নন।
গতকাল মেলায় যদি লাখো মানুষ উপস্থিত হয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হবে পাঠক ছিলেন পাঁচ-সাত হাজার। আমি দু-তিনটি নামি প্রকাশকের প্যাভিলিয়নের কাছাকাছি একটা জায়গায় প্রায় ৩০-৩৫ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করেছি কতজনের হাতে বইয়ের প্যাকেট আছে। আমার চারপাশ দিয়ে অজস্র মানুষ ঢুকছিলেন ও বেরোচ্ছিলেন। আমি ওই জনস্রোতের মধ্যে মাত্র পাঁচ-ছয়জনের হাতে বইয়ের প্যাকেট দেখেছি। কোনো দম্পতি বা টিনএজারের হাতে বই দেখিনি। ব্যতিক্রম ছিল কিশোরীরা। তাদের হাতেই বইয়ের প্যাকেট দেখেছি সবচেয়ে বেশি। আসলে একুশের দিনে মেলায় সাধারণত পাঠক আসেন না। আগেও এটা দেখেছি। এবার এই সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। একজন প্রকাশক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, এবার মেলার খরচ উঠবে কি না, তাই নিয়ে শঙ্কায় আছি। সামনের এক সপ্তাহের অপেক্ষায় আছেন তারা। আগের প্রতিটি মেলার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শেষ সপ্তাহেই প্রকৃত পাঠকরা পছন্দের বই কেনার জন্য বইমেলায় আসেন। এখন যারা আসছেন, বিশেষ করে গতকাল, তারা পর্যটক। পাঠক নন।
বিদ্যাপ্রকাশের সামনে দেখা হলো কথাশিল্পী সুমন মজুমদারের সঙ্গে। গত বছর তার প্রকাশিত উপন্যাস ‘রাইমঙ্গল’ বাংলা অ্যাকাডেমি রাবেয়া খাতুন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিল। এবার তিনি প্রকাশ করেছেন একটি গল্পগ্রন্থ ‘ঘোড়াগুলো ঘুমাবে’। প্রকাশক বিদ্যাপ্রকাশ। অফিস ছুটির দিনগুলোতে তিনি মেলায় আসছেন। এবারের মেলা সম্পর্কে সুমন কিছুটা হতাশ। ‘অনেক অগোছালো মনে হচ্ছে’, বললেন তিনি। লক্ষ করছেন পরিচিত লেখকদের অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিতি বই বিক্রিতেও প্রভাব বিস্তার করছে। অনেকে আবার মেলায় আসছেন না। লেখকদের মধ্যে মতের ভিন্নতা ও মেরূকরণ তীব্র হয়েছে। এ কারণে অনেক লেখক মেলায় আসছেন না। কিন্তু লেখকরাই বইমেলার প্রাণ। এ কারণেই সুমন বললেন, ‘মেলাটা ছেড়ে দিতে চাই না। এটা তো আমাদের মেলা। তাই মেলায় আসি।’
বইমেলার একটা বৈশিষ্ট্য প্রায় সব সময় দেখা গেছে। রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত থাকেন, তাদের মতাদর্শই বইমেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সাজসজ্জায় প্রতিফলিত হয়। যতগুলো সেমিনার হয়, তার প্রায় সবগুলোই শাসকদের মতাদর্শের দিকে লক্ষ রেখে আয়োজন করা হয়। গত দেড় দশকে বইমেলায় শাসক দলের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এবারও শাসকদের খুশি করার জন্য একই ধরনের সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এসব সেমিনারে যারা শাসকদের ঘনিষ্ঠ, তাদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারা এবারের বইমেলাকে ‘লাল জুলাই’ অথবা গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পাওয়া বইমেলা বলে চিহ্নিত করছেন। বইমেলা এ কারণে কখনো দলীয় মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ভবিষ্যতে কখনো পারবে বলে মনে হয় না। বাংলা অ্যাকাডেমি আয়োজিত বইমেলা সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র বইমেলা, যেখানে লেখক-পাঠক-প্রকাশককে ছাপিয়ে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ প্রধান হয়ে ওঠে। পৃথিবীর অন্য কোনো বইমেলায় এটা দেখা যায় না।
গতকালের বইমেলা ছিল বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত। বিকেল ৫টার দিকে টিএসসির গেট দিয়ে ভিড় ঠেলে ঢুকতে হয়েছে। কিন্তু বেরোনোর সময় মানুষের এত চাপ ছিল যে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও বেরোতে পারিনি। পরে বাংলা অ্যাকাডেমির গেটের দিকে গিয়ে বেরোতে হয়েছে আমাকে। বইমেলাজুড়ে শুধু হকার আর হকার। একজন পুলিশকে উষ্মার সঙ্গে এ রকম অব্যবস্থাপনার কথা বলতে তিনি বললেন, ‘বাংলা অ্যাকাডেমি যে নির্দেশনা দেয়, আমরা সেইভাবে চলি।’ আমি যখন বললাম, ‘বেরোনোর গেটের মুখে আগে কোনোদিন এত এত ভ্যান নিয়ে কেনাবেচা করতে দেখিনি। কিন্তু এবারই সেটা দেখছি। প্রতিদিন একই দৃশ্য। মানুষ বেরোতে পারছে না, আপনারা কী করেন?’ বললেন, ‘বাংলা অ্যাকাডেমিকে বলেন। বাংলা অ্যাকাডেমিই ব্যর্থ। তাদের জন্যই এই অব্যবস্থাপনা। আমাদের নির্দেশ দিলে অবশ্যই আমরা সেটা পালন করতাম।’ তার কথা শুনতে শুনতে স্মৃতি হাতড়ে দেখার চেষ্টা করলাম, বিগত ৪০ বছরে এ রকম বিশৃঙ্খল বইমেলা দেখেছি কি না।