
একসময় বাংলা একাডেমির বইমেলাতে অনেক আসতাম। গত ১৫ বছরে আমি বইমেলাতে আসিনি। কারণ, আসার মতো উৎসাহ-উদ্দীপনা আমার ছিল না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চাই এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বাংলা একাডেমি শহিদ জিয়াউর রহমানের জীবনীর ওপর একটা প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পের যে সম্পাদনা পরিষদ তারা আমাকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছে। সে কারণেই প্রকল্পের কাজে বাংলা একাডেমিতে কয়েকবার গিয়েছি। ইতোমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীর ওপর কাজ শেষ করেছে। এ ছাড়া মওলানা ভাসানী ও শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের ওপর জীবনী গ্রন্থ বের করার প্রকল্প নিয়েছে।
বইমেলায় প্রতি বছরের মতো এবারও অনেক বই প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বইগুলো ততটা মানসম্পন্ন নয়। কিছু ভালো প্রকাশনা মানসম্পন্ন গ্রন্থ বের করলেও বেশির ভাগই নিম্নমানের। তবে গবেষণাধর্মী বই খুব কম। বইমেলায় লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের মিলনমেলা হয়। আমার লেখা মোট বইয়ের সংখ্যা ২৫। এবার অনন্যা প্রকাশনা থেকে গবেষণাধর্মী বই ‘নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও মতবাদ’ প্রকাশ হয়েছে।
এ দেশের একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে আমি খুবই মর্মাহত। কারণ, শিক্ষার মান ও শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি চরম অবনতির দিকে চলে গেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। ধারণা করেছিলাম শিক্ষার ব্যাপারেও একটি কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটি এই সরকারের নজরে আসেনি। নজরে আসলেও কী কারণে তারা শিক্ষা কমিশন গঠন করলেন না, তা জানি না। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষিত জাতিগোষ্ঠী গড়তে গেলে অবশ্যই শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে হবে। যুগোপযোগী ও গণমুখী শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা না দিলে জাতি হিসেবে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব। মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারলে দেশের সমস্যা এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। উচ্চশিক্ষার জগতে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো দলীয় রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকরা সরকারের চাটুকারে পরিণত হয়েছে। এভাবেই চাটুকারিতা করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। অন্তত একটা তদন্ত কমিশন গঠন করে গত ১৬ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক এবং কিছু ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শুদ্ধ করে বাংলা ও ইংরেজি লিখতে পারে না। অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এখন নাকি বাংলা পড়ায় না। কেন পড়ায় না তা আমি জানি না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা এবং এই ভাষার জন্য শিক্ষার্থীরা প্রাণ দিয়েছেন। অথচ এখন এর গুরুত্ব কমে গেছে। ইংরেজি ভাষা এখন প্রযুক্তিতে পরিণত হয়েছে। বিদেশে আমরা শুধু শ্রমিক পাঠাই, কোনো দক্ষ লোক পাঠাতে পারি না। আমি বাহরাইনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলাম। সেখানে ভারত থেকে আসা অনেক নার্স পাওয়া যায়, অথচ আমাদের দেশের কোনো নার্স নেই। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্স ইনস্টিটিউট খুলে দেওয়া উচিত। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। শিক্ষার প্রতি কারও নজর নেই।
বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বের। শিক্ষকরা সিনিয়র স্কলার এবং ছাত্ররা হলো জুনিয়র স্কলার। আশা করি ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছেন তা এ দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
লেখক: সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: সানজিদ সকাল