
সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর তুলনায় শুক্র ও শনিবার বইমেলা বেশি জমে। পাঠক-দর্শনার্থী-লেখক আর প্রকাশকের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। আড্ডা-গল্প ছাপিয়ে, প্রিয় লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎ, সেলফি, অটোগ্রাফ যেন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় এই দুই দিনে। ক্রেতা আর দর্শনার্থীদের ভিড়ে দম ফেলানোর সময় পান না বিক্রয়কর্মী থেকে প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) মেলার ২২তম দিন ছিল তেমনই একটি দিন, এই দিন শিশুপ্রহরের মধ্য দিয়ে মেলার দুয়ার খোলে বেলা ১১টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। শুরুতেই পাঠক-দর্শনার্থীতে মুখর ছিল মেলাপ্রাঙ্গণ, যদিও ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত মেলা ক্ষুদে পাঠক-দর্শনার্থীদের দখলে থাকলেও বিক্রি বেশ ভালো ছিল সূর্যের লুকোচুরির খেলার মাঝে।
এমন লুকোচুরি সকলকেই বৈরী আবহাওয়ার বার্তা দিচ্ছিল, মাঝেমাঝে বাংলা একাডেমির মাইকেও বৈরী আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছিল যেন আগত দর্শক থেকে শুরু করে স্টল মালিক সকলেই সচেতন থাকেন। এভাবেই বেলা গড়াতে না গড়াতে যেই না সন্ধ্যা ৬টা বাজতে মিনিট ১০ বাকি, মুহূর্তের মধ্যে জমজমাট বইমেলা ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে। যে যার মতো করে বৃষ্টিতে ভেজা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে খুঁজতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়।
এদেরই মধ্যে ছিলেন আশরাফ-তমা দম্পতি ও তাদের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে মৃদুলা। রাজধানীর মতিঝিল থেকে এসেছেন। অন্যদের মতো তারাও বৃষ্টি উপেক্ষা করে অন্যদের মতো জোরেশোরে হেঁটে চলছেন নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। পরে তাদের ঠাঁই মেলে মেলার ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের ছাউনিতে। সেখানে কথা হয় খবরের কাগজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। মেলা ঘুরে এই ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম মুরশিদের আত্মজীবনী ‘আত্মকথা ইতিহাস’ কিনেছেন যদিও আরও বেশকিছু উপন্যাস এবং মেয়ের জন্য কিছু বই কিনবেন।
আশরাফ হোসাইন বলেন, ‘আজ আমাদের প্রথম মেলা আসা। কিন্তু মেলায় এসেই বৃষ্টিতে ভিজতে হলো। এর মাঝে একটি মাত্র বই কেনা হয়েছে আরও কিছু বই কেনা বাকি রয়েছে। এদিকে মেয়ে কিছু কমিকস বই কিনতে চায়, সেগুলো কিনতে যেতে হবে বাংলা একাডেমিতে। হয়তো আজ আর কেনা হবে না কিছুই, ফের আসতে হবে।’
বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আশরাফের মতো ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ঝুমাসহ তার পাঁচজন সহপাঠী। নুসাইবা ঝুমা খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের সকলের প্ল্যান ছিল মেট্রোতে করে সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছাব কিন্তু স্টেশন থেকে নেমে মেলার কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টি শুরু। হয়তো বই কেনা আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে সামনের শুক্রবার আসা লাগবে। তারপরও দেখি বৃষ্টি কিছুটা কমলে যদি কোনো বই পছন্দ হয়, কেনা যাবে তখন।’
এভাবেই বৃষ্টি চলে সোয়া ৭টা পর্যন্ত। পরে মিনিট ২০-৩০ যেতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি কেটে যায়। সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, স্টলগুলোতে তেমন ভিড় নেই। তবে কাকলী প্রকাশনীর স্টলে লোকজনের কমতি নেই। স্টলের বিক্রয়কর্মীরা বলছেন, চিরায়ত লেখকের বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের বই খুঁজতে দেখা যায় অনেককে। প্রকাশনাটির বিক্রয়কর্মী এ.টি.এম মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আজকে বিক্রি ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পরপর বৃষ্টি নামাতে মেলা একেবারেই পণ্ড হয়ে গেছে। তারপরে বৃষ্টি থামার পর যে এমন লোক দেখব ভাবিনি তবে বেশির ভাগই হুমায়ূন আহমেদের বই খুঁজছেন। হয়তো একদল হুমায়ূন ভক্তই কোনো অজ্ঞাত কারণে বৃষ্টির পরেও রয়ে গেছেন।’
কয়েক কদম আগাতে নালন্দার স্টল। কথা হয় প্রকাশনীটির সিও জাহিদুল ইসলাম তুহিনের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুরুতে মেলা ভালোই চলছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে অনেকটাই বিঘ্ন ঘটেছে। বৃষ্টির পানি প্রবেশ করাতে সামান্য কিছু বই ভিজেছে।’
অন্য স্টলগুলো বৃষ্টিতে কিছুটা ভিজলেও আফসার ব্রাদার্সের স্টল পুরোটা টিন দিয়ে তৈরি করার কারণে স্টলের বইসহ কিছুই বৃষ্টিতে ভিজেনি। স্টল না ভিজলেও স্টলে ভেজা লেখক সাহাদত হোসেন খান বেশ বিষণ্ণ, সাধারণত সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে পাঠক-লেখকের বেশ মিথস্ক্রিয়া জমে ওঠে। বৃষ্টির কারণে সেটি আর জমেনি। সাহাদত হোসেন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি শুরুতে মেলাতেই ছিলাম। সবকিছুই ঠিক ছিল কিন্তু বৃষ্টি আসাতে মেলা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’
বৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হলেও আগামী দিনের মেলা বেশ ভালো কাটবে বলে প্রত্যাশা এই লেখকের। এদিকে ২২তম দিনে বাংলা একাডেমিতে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় কায়কোবাদের সাহিত্যে শ্মশানের চিত্রাবলি শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইমরান কামাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন হাবিব আর রহমান এবং সভাপতিত্ব করেন আবু দায়েন। এদিকে লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক হাবিব আর রহমান এবং কবি আমিরুল মোমেনীন মানিক।
এখন পর্যন্ত নতুন বই ২৩৬১টি:
গতকাল নতুন বই এসেছিল ১১৪টি। শুক্রবার এ সংখ্যা ছিল ৩০৭টি। এ নিয়ে এবারের বইমেলায় প্রকাশ হওয়া নতুন বইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৩৬১টিতে।