
অমর একুশে বইমেলা শেষ হতে বাকি আর তিন দিন। চিরায়ত নিয়মানুযায়ী বইমেলার শেষ সপ্তাহে বইয়ের বিকিকিনি থাকে তুঙ্গে। কিন্তু এবারের বইমেলার চিত্র ভিন্ন। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতায় বইমেলার শুরুতে যে মন্দাভাব শুরু হয়েছে, তা বলবৎ রয়েছে শেষ সপ্তাহে।
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার একাধিক প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল এমন কথা।
তাদের ভাষ্যে, শেষ বেলায় যতটুকু দর্শক-পাঠক সমাগম হয়েছে, বইমেলায় তাদের সিকিভাগই বই কেনেননি।
প্রকাশনী সংস্থা অনন্যার প্রকাশক মনিরুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘মেলার শুরু থেকেই তো মন্দাভাব লেগে আছে। দর্শক, পাঠক সমাগম নেহায়েত কম হয়েছে তা বলব না। যথেষ্টই ছিল সব কটি দিন। কিন্তু তারা এবার তেমন বই কিনছেন না। প্যাভিলিয়ন বা স্টলগুলোতে এসে বই দেখে চলে যাচ্ছেন।’
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বইমেলার মূল আকর্ষণ লেখকরা। আমাদের প্রকাশনীতে বাংলাদেশের প্রথিতযশা সব লেখকের বই থাকলেও তারা কিন্তু বইমেলায় আসেননি। তাদের টানে অনেক তরুণ আসেন, তারা বই কেনেন, বই নিয়ে কথা বলেন। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অনেক লেখক বইমেলাতে আসতে চাননি। তাই পাঠকরাও বইমেলাবিমুখ হয়েছেন।’
অবসর প্রকাশনীর কর্ণধার নুর-ই-মুনতাকিম আলমগীর বলেন, ‘চিরায়ত বইয়ের জন্য অবসর প্রকাশনীতে তরুণদের ভিড় লেগে থাকত। সেই ভিড়টা এ বছর নেই। তরুণরা ক্রমেই বইবিমুখ হচ্ছেন। এ বছর যত টাকা লগ্নি করেছি বইয়ের জন্য, তার কত শতাংশ উঠে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
‘ইত্যাদি’র অন্যতম কর্ণধার জহিরুল আবেদিন জুয়েল অবশ্য দায় দেখেন বইমেলার পরিবেশের। ইত্যাদির প্যাভিলিয়নে গতকাল সন্ধ্যায় যখন কথা হচ্ছিল জুয়েলের সঙ্গে, তখন পাশে দেখা গেল ভ্রাম্যমাণ হকারদের উৎপাত। এই দৃশ্য দেখিয়ে প্রকাশক জুয়েল বলেন, ‘বেশ অনেক বছর বইমেলায় হকার প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এ বছর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রান্তে অবাধে হকার প্রবেশ করেছে। কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
পাঠক এসে নির্বিঘ্নে বই কিনবেন, কোথাও বসে নতুন কেনা বইটি একটু পড়বেন, সেই পরিবেশ নেই। পাঠক এমন দৃশ্য দেখে যারপরনাই বিরক্ত। অনেক পাঠক বই না কিনে ফেরত গেছেন।’
প্রকাশনী সংস্থা মুক্তধারার বিপণন কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ সেন বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ব্যাপক ছাপ পড়েছে এবারের বইমেলায়। বইমেলায় তরুণরা রোমান্টিক উপন্যাসই বেশি খুঁজেছেন। তবে এবার জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে রচিত বইয়ের দিকে তাদের নজর বেশি দেখেছি। সব মিলিয়ে পাঠকের রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে আমরা প্রকাশকরাও হয়তো সবাই পেরে ওঠেনি। তারা যে ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন, সে ধরনের বই হয়তো আমরা আনতে পারিনি বইমেলায়। তাই বিক্রির অবস্থা এক কথায় খারাপ।’
আফসার ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপক শাহরিয়ার জাওয়াদ বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাসের দিকে তরুণদের ঝোঁক থাকলেও এবার তারা রাজনৈতিক গল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। সমসাময়িক রাজনীতির বইগুলো ভালো বিক্রি হয়েছে।’
শিশু-কিশোরভিত্তিক লিটলম্যাগ প্রকাশনা ‘দোলন’ এবার লিটলম্যাগের চত্বর থেকে মেলার মূল চত্বরে ঠাঁই পেয়েছে। তরুণ প্রকাশক কামাল মোস্তফা বলেন, ‘এ বছর ৩০টি নতুন বই প্রকাশ করেছি। লেখকরা সবাই তরুণ। মেলার নতুন প্রকাশক হিসেবে ভালোই সাড়া পেয়েছি।’
ব্রেইলভিত্তিক প্রকাশনা সংস্থা ‘স্পর্শ’ থেকে এবার ১০টি ব্রেইল বই প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন। এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে লায়লা খন্দকারের ‘স্বপ্ন ভূমিতে রঙধনু সাপ’, রহিমা আক্তার মৌয়ের ‘গল্পে গল্পে ফেব্রুয়ারি’, নাজনীন নাহারের ‘মনভালোদের স্বরলিপি’, বাংলা অর্থ ও উচ্চারণসহ পাঁচটি সুরার বইয়ের সংকলন, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘তিব্বতের লোককাহিনী’।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সাইফুদ্দিন রফিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছেন সম্প্রতি। তিনি গতকালই প্রথম এসেছেন ব্রেইল প্রকাশনা ‘স্পর্শ’-এর স্টলে। তিনি বলেন, ‘আজ এখানে এসে বইগুলো পড়ে দেখছি। স্পর্শকে বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে হবে যে তারা আমাদের কাছে সাহিত্যকে সহজ করে এনেছে। আমি থ্রিলার পড়তে ভালোবাসি। তাই স্পর্শ-এর উদ্যোক্তাদের বলেছি, তারা যেন আমাদের জন্য ভালো ভালো থ্রিলার আর অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ নিয়ে আসেন।’
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী গতকাল বইমেলায় নতুন বই এসেছে ৯৮টি।
গতকাল বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জনআকাঙ্ক্ষার নাট্যকলা-যাত্রা: ঐতিহ্যের পরম্পরায় জাতীয়তাবাদী শিল্পরীতি এবং অমলেন্দু বিশ্বাস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইদুর রহমান লিপন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শাহমান মৈশান। সভাপতিত্ব করেন মিলনকান্তি দে।
‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি শাহীন রেজা, কবি এজাজ ইউসুফী এবং কবি শোভা চৌধুরী।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি ফাতিমা তামান্না, টোকন ঠাকুর এবং রশিদ কামাল। এ ছাড়া আবৃত্তি করেন মাহবুব মুকুল এবং নূরুল হাসনাত জিলান। গতকাল ছিল সেলিনা ফারজানা কেয়ার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমি’ এবং আলী আশরাফ আখন্দের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জিয়া সাংস্কৃতিক জোট’-এর পরিবেশনা।
আজ বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘জুলাই অভ্যুত্থান: গ্রাফিতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।
প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মুনেম ওয়াসিফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন তাসলিমা আখতার এবং কামার আহমাদ সাইমন। সভাপতিত্ব করবেন ফারুক ওয়াসিফ।