
অমর একুশে বইমেলায় প্রথিতযশা অনেক প্রকাশনীর পাশাপাশি এবার একদম নতুন ৮৫টি প্রকাশনী-সংস্থা এক বা দুই ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অনেক নতুন প্রকাশনীও এবারের বইমেলায় অংশ নিয়েছে। তবে মেলার ২৫তম দিনে এসে এসব প্রকাশনীর প্রকাশক, ব্যবস্থাপকরা জানালেন, এবার পুরো বইমেলা ‘ভীষণ মন্দা গেছে’। তারা যা প্রত্যাশা করেছিলেন, সে অনুযায়ী বিক্রি হয়নি। দর্শক-পাঠক সমাগম তেমন নেই। এক ইউনিটের অনেক স্টলে ঢুঁ মেরে জানা গেছে, তাদের স্টলে আসা অনেক নতুন বইয়ের কোনো কপি বিক্রি হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে নাগরিক প্রকাশন, স্বনির্ভর প্রকাশন, ভিন্ন চোখ, পাতাপ্রকাশ, সাহস পাবলিকেশনস, জ্ঞানসঙ্গী প্রকাশনা, রশিদিয়া লাইব্রেরিসহ বেশ কয়েকটি নবীন প্রকাশনা সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়। নাগরিক প্রকাশনের এস এম জাকির হাসান জানান, এবারের বইমেলায় তারা প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছেন। তাদের স্টলে বেশি বিক্রি হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের ‘কারাবাসের বাইশ মাস’ ও ‘গুম’ নামের দুটি বই। ২০২২ সালে এই দুটি বই প্রকাশ করে এই প্রকাশনী আলোচনায় আসে। আধ্যাত্মিকতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই তাদের স্টলে চোখে পড়ে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রমনা কালীমন্দির গেটের প্রবেশপথ পেরোলেই নাগরিকের স্টল। কিন্তু পাঠক ও ক্রেতাসমাগম কম বলে জানালেন জাকির হাসান। তিনি বলেন, ‘মন্দিরের গেট দিয়ে ঢুকেই সবার নজর থাকে বড় প্রকাশনীতে, প্যাভিলিয়নের দিকে। এদিকে যে কয়েকজন প্রকাশক আছেন, তাদের দিকে ফিরেও তাকান না তারা। স্টলে এসে বই দেখে চলে যান, কিন্তু কেনেন না।’ কথা বলতে বলতে তিনি আনন্দলোক, পাতা, জলছবি, মেঘ- প্রকাশনীর স্টলগুলো দেখিয়ে বলেন, ‘এই প্রকাশনীগুলোতেও তরুণ লেখকদের দারুণ কবিতা, গল্পের বই আছে। পাঠক যদি তরুণদের বই না কেনেন। তবে এই তরুণরা বড় হবেন কী করে? খালি সেই সিনিয়র লেখক, ঔপন্যাসিকের বই খুঁজব, আর প্যাভিলিয়নে যাব, তাহলে আমরা টিকে থাকব কী করে?’
আক্ষেপের সুর শোনা গেল জ্ঞানসঙ্গী প্রকাশনার স্টল ব্যবস্থাপক সুমি আক্তার, রশিদিয়া লাইব্রেরির ব্যবস্থাপক মো. রমজান আলীর কণ্ঠেও। দুটি প্রকাশনীই এবারের বইমেলায় প্রথমবারের মতো স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। রশিদিয়ার মো. রমজান জানান, কুষ্টিয়ার চিশতিয়া দরবার শরীফের মতবাদ নিয়ে ২৫টি পুরোনো বই নিয়ে তারা স্টল সাজিয়েছেন। যারা এই মতবাদ নিয়ে জানতে-বুঝতে চান শুধু তারাই এসেছেন স্টলে। বিক্রি কেমন হলো জানতে চাইলে রমজান বলেন, ‘একেবারেই বিক্রি নেই।’
তরুণ লেখক, কবিদের ১৫টি নতুন বই নিয়ে এসেছে জ্ঞানসঙ্গী প্রকাশনা। ‘বিশ্বভরা প্রাণ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানার থেকে এ প্রকাশটির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে জানান ব্যবস্থাপক সুমি আক্তার। তাদের প্রত্যাশা ছিল, বইমেলায় তরুণ লেখকদের কবিতার বই ভালো বিক্রি হবে। কিন্তু বইমেলার নিদারুণ বাস্তবতায় তাদের আশাভঙ্গ হয়েছে। এই স্টলেই কথা হয় ভারত থেকে আসা কবি, লেখক বিধুয়া ধরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতি তিন বছর অন্তর অমর একুশে বইমেলায় আসি। এবারই এসে দেখলাম, পাঠক কবিতার বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর বইমেলায় যারা নবীন প্রকাশক তাদের প্রকাশনায় তো বিক্রিবাট্টা একদম নেই। এটা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। আর বইমেলায় লেখক-পাঠকের আড্ডা নেই। কেমন যেন নিষ্প্রাণ সবকিছু।’
পুঁথিপ্রকাশ, মহানগর, সাহস পাবলিকেশনসের স্টল ব্যবস্থাপকরা জানালেন, রমনা কালীমন্দিরের পাশে তাদের পাশাপাশি এক, দুই বা তিন ইউনিটের স্টল যারা পেয়েছেন তাদের স্টলে বিক্রি ‘খুব খারাপ।’
গতকাল বিকেলে বইমেলায় ঘুরতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা রাজিব হালদার নবরাগ প্রকাশনী থেকে মোহনা জাহ্নবীর গল্পের বই ‘কেউ কেউ কথা রাখে’ বইটি কিনে নেন। তিনি বলেন, ‘এদিকের স্টলগুলোতে আমার অনেক তরুণ বন্ধুর লেখা বই আছে। আমি তালিকা তৈরি করেই এসেছি। বন্ধুদের বইগুলো যত ছোট স্টলেই থাকুক না কেন, আসলে প্রচার-প্রচারণা তো আমাদের পাঠকদেরই করতে হবে।’
অবশ্য ছোট প্রকাশনীর স্টলগুলো নিয়ে অভিযোগেরও শেষ নেই। স্বনির্ভর প্রকাশনের স্টলে ঢুঁ মেরে আসা পাঠক আশিকুর রহমান বলেন, ‘নামেই সৃজনশীল প্রকাশনা। গিয়ে দেখলাম, বাচ্চাদের অঙ্ক শেখা, ইংরেজি শেখার বই বিক্রি করছে।’
মুজাহিদুল ইসলাম এসেছিলেন রাজশাহী থেকে। তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে এই নবীন প্রকাশকদের স্টলে ঘুরেছেন। শেষে হতাশা নিয়ে বললেন, ‘বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম, দুই-তিন পাতাও পড়েছি। কিন্তু বইগুলোর শব্দ, বাক্য কোনো কিছুর ঠিক নেই। অনেক প্রকাশকের কাছে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই আছে। কিন্তু আমি এসব গল্প, উপন্যাস আগেও কোনো বইয়ে পড়েছি। অনুবাদের বই দেখলাম, সেগুলো স্রেফ পাইরেটেড।’
বইমেলার এই প্রকাশনীগুলোর হালহকিকত নিয়ে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব সরকার আমিন বলেন, ‘কে কোথায় স্টল পাবে, এটা তো একেবারেই লটারির ওপর নির্ভর করে। আর রমনা কালীমন্দিরের পাশে আমরা এবার যথেষ্ট আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছি। আর এসব প্রকাশনীতে যদি ভালো বই থাকে, তবে পাঠকরা নিজ উদ্যোগে এসব প্রকাশনীর স্টল খুঁজে নেবে। তাদেরও বিক্রি বাড়বে তখন।’
বাংলা একাডেমির হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বইমেলায় নতুন বই এসেছে ১০১টি।
গতকাল বিকেলে বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘গণ-অভ্যুত্থান, গ্রাফিতি এবং অপরাপর ভিজ্যুয়াল কালচার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুনেম ওয়াসিফ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন তাসলিমা আখতার এবং কামার আহমাদ সাইমন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
প্রাবন্ধিক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এবং পরে দেওয়ালে দেওয়ালে আঁকা গ্রাফিতি, চিত্র ও লেখাগুলো থেকে বোঝা যায়, গত এক দশকের বেশি সময় আমরা যে ক্ষমতার জাঁতাকলের মধ্যে বসবাস করেছি, তরুণ প্রজন্ম সেই ক্ষমতার কর্তৃত্বকে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের বেশির ভাগ গ্রাফিতি ও চিত্রগুলো গতানুগতিক শিল্পধারা অনুসরণ করেনি। এ জন্যই সেগুলো এত অসাধারণ। এসব ছবির মাঝে এক ধরনের তেজ, ক্রোধ, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস এবং উপহাস কিংবা গভীর রাজনৈতিক বিষয়কে হাস্যরসে পরিণত করার প্রবণতা আছে। এর ভিত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই আস্তে আস্তে তৈরি হয়েছে।
‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও সম্পাদক শওকত হোসেন এবং কবি শামীমা চৌধুরী।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫
অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি পরিচালিত চিত্তরঞ্জন সাহা, মুনীর চৌধুরী, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ও শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল।
২০২৪ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিকসংখ্যক বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কথাপ্রকাশকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’; ২০২৪ সালে প্রকাশিত বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা বইয়ের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঠক সমাবেশ (প্লেটো: জীবন ও দর্শন-আমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া), ঐতিহ্য (ভাষা শহিদ আবুল বরকত: নেপথ্য কথা- বদরুদ্দোজা হারুন) এবং কথাপ্রকাশকে (গোরস্তানের পদ্য: স্মৃতি ও জীবনস্বপ্ন- সিরাজ সালেকীন) ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালে গুণমান বিচারে সর্বাধিকসংখ্যক শিশুতোষ বই প্রকাশের জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কাকাতুয়াকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়।
অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ উপলক্ষে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাকতাবাতুল ইসলাম (১ ইউনিট); গ্রন্থিক প্রকাশন (২-৪ ইউনিট) ও বাতিঘরকে (প্যাভিলিয়ন) ‘কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে।