
তরুণ পাঠকদের মধ্যে সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞানের যে ঝোঁক, তা এবারের বইমেলায় নাকি একটু কমেছে! তরুণ পাঠকদের ভাষ্যে, এবারের বইমেলায় জুতসই বই মেলেনি, তাই কল্পবিজ্ঞানে আগ্রহ কমছে। কিন্তু স্কুলপড়ুয়া খুদে পাঠকদের কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম পাঠ মানেই হলো, কল্পবিজ্ঞান। আর এ কথাটির প্রমাণ মিলেছে প্রায় প্রতিদিন। বেলা ৩টায় বইমেলার দুয়ার খুলতে যতক্ষণ, এরপর স্কুলপড়ুয়ারা এসে খুঁজতে থাকে কল্পবিজ্ঞানের সব বই। স্মার্টফোনে প্রিয় বইটির প্রচ্ছদ দেখিয়ে উৎসুক পাঠকের জিজ্ঞাসাও শোনা গেছে হরদম- ‘ভাইয়া দেখুন তো, সায়েন্স ফিকশনের এ বইটির কপি আছে কি না!’
কল্পবিজ্ঞানপ্রিয় খুদে লেখকদের জন্য এবারের বইমেলায় সময় প্রকাশন থেকে এসেছে ড. হাসিনুর রহমান খানের ‘গ্যালাক্টিক ত্রয়ী’, রাবেয়া বুকস্ থেকে এসেছে আহমেদ বায়েজীদের ‘মহাকাশে দুঃস্বপ্ন’, আফসার ব্রাদার্স প্রকাশিত জসীম আল ফাহিমের ‘বিজ্ঞানী মামার কাণ্ডকারখানা’, অনন্যা এনেছে মুহাম্মদ ইব্রাহীমের ‘দুই বুদ্ধি’, র্যামন পাবলিশার্স এনেছে রোকনুজ্জামান রিপনের ‘শেষ জ্যোৎস্না’ ও ড. মো. মনসুর আলীর ‘মহাকাশের সন্ধানে’, অবসর প্রকাশনা সংস্থা এনেছে হাসান খুরশীদ রুমীর ‘ইভ অব ম্যান’।
প্রতিবার বইমেলাতেই প্রবন্ধ ও মননশীল সাহিত্যের একদল তরুণ পাঠকের দেখা মেলে। তাদের ভাষ্যে, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে রচিত সৃজনশীল সাহিত্য তাদের জ্ঞানের জগৎকে আরও সমৃদ্ধ করে। উচ্চশিক্ষার নানা স্তরে এই বইগুলো ‘রেফারেন্স বুক’ হিসেবে কাজ করে বলে মননশীল সাহিত্যের প্রতি ক্রমেই আগ্রহ বাড়ছে তাদের মধ্যে।
বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, মননশীল বা প্রবন্ধের বই এসেছে ৭০টি। এবার বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মোজাফ্ফর হোসেনের ‘ব্রাহ্মসমাজে ইসলাম সাহিত্যের সক্রিয়তাবাদ ও অন্যান্য’, অনন্যা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গোলাম মাওলা রনির ‘কি দেখেছি কি দেখছি’, কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ওয়াসি আহমেদের ‘টিকিটাকা’, পালক পাবলিশার্স থেকে এসেছে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের ‘শিক্ষার তিন ভুবনে’, ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে মো. আবদুল হাই ভূঁইয়ার ‘স্বার্থপরতার অর্থনীতি’, সাহস পাবলিকেশনস থেকে এসেছে শহীদুজ্জামানের ‘আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের তত্ত্বাবলি’, পাঠক সমাবেশ প্রকাশ করেছে আবু সাইদ খানের ‘মুক্তিসংগ্রামে বিপ্লববাদ ও অন্যান্য’, জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে সেলিম জাহানের ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’।
গত বছরের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের ছাপ পড়েছে এবারের অমর একুশে বইমেলায়। বইমেলার প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিবছর বইমেলায় যত টাকা তারা লগ্নি করেন, এ বছর তার অর্ধেকও করেননি। বই বিক্রিতে ‘মন্দাভাব’ ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
জাগৃতির প্রকাশক রাজিয়া রহমান বলেন, ‘এবার নতুন বই বের করেছি ১৬টি। আগে বইমেলায় অন্তত ৩০টি নতুন বই আসত আমাদের প্রকাশনী থেকে। এবার দেশের যা পরিস্থিতি, খুব বেশি টাকা লগ্নি করতে চাইনি। মেলার অবস্থাও ভালো ছিল না। শুরু থেকেই যে মন্দাভাব লেগেছে, তা বইমেলার শেষভাগেও এসে রয়ে গেল। এবারের বইমেলা সত্যি বাজে কেটেছে।’
পালক পাবলিশার্সের স্বত্বাধিকারী ফোরকান আহমদ বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরেই তো দেখছি, এই বইমেলা কীভাবে ক্রমে বিবর্ণ হচ্ছে। বই বিক্রি কম হবে বা বেশি হবে, সেটি সরিয়ে রাখলেও পাঠক, প্রকাশক ও ক্রেতার যে মিথস্ক্রিয়া সেটি ক্রমাগত যেন মিইয়ে যাচ্ছে। বইমেলায় ক্রেতা কমে যাচ্ছে। অবশ্য তাদের জন্য যথাযথ পরিবেশ আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি না, সেটা একটা প্রশ্ন।’
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ছিল অমর একুশে বইমেলার ২৭তম দিন। এদিন বাংলা একাডেমির নতুন বইয়ের স্টলে নতুন বই এসেছে ১৭৬টি। এর মধ্যে রয়েছে গীতিকবি আসিফ আকবরের নতুন বই যদি লক্ষ্য থাকে অটুট- সাফল্যের খোলা কৌশল’। বাংলাদেশের করপোরেট জগতের উল্লেখযোগ্য নাম আসিফ ইকবাল, গীতিকবি হিসেবেও তিনি সমান উজ্জ্বল। নিয়মিত করছেন শিক্ষকতাও। সংগঠক হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। তিন দশকের অধিক সময়ের ক্যারিয়ারে তিনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন এ বইয়ে। বইটি বের হয়েছে অন্যপ্রকাশ থেকে।
গতকাল বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘একটি অভ্যুত্থানের জন্ম ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রেজাউল করিম রনি। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সৈয়দ নিজার। সভাপতিত্ব করেন কাজী মারুফ। ‘লেখক বলছি’ মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি সায়ীদ আবুবকর, কবি মিতা আলী এবং কবি, সম্পাদক ও শিশুসাহিত্যিক জামসেদ ওয়াজেদ।
আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি) বইমেলার শেষ দিন। এদিন মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায় এবং চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর।
আজ বিকেল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন অমর একুশে বইমেলার সদস্যসচিব ড. সরকার আমিন। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
সমাপনী অনুষ্ঠানে কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার, চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।