সিলেটের প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় লিডিং ইউনিভার্সিটির ‘সংস্কার’ ২৪ ঘন্টার মধ্যে করার দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা।
ট্রাস্টি বোর্ডে ‘ভারতীয় নাগরিক’ থাকার অভিযোগ, দুই শিক্ষকের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে উপাচার্যের কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখাসহ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা পেয়েও দুই শিক্ষককে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার না করায় সংস্কারে ‘স্পষ্ট বিবৃতি’ দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (১০ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন লিডিং ইউনিভার্সিটি শাখা ‘স্পষ্ট বিবৃতি’ দিয়েছে।
এতে রবিবার (১১ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে সংস্কারে আলটিমেটাম দিয়ে বলা হয়, ‘কোটা আন্দোলনে আমরা আপনাদের অবস্থান নিয়ে এখন চিন্তিত না। এখন আমাদের লিডিং ইউনিভার্সিটি সংস্কারের লক্ষ্যে ১১ আগস্ট রবিবার আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করুন।...’
শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কোষাধ্যক্ষ পদে থাকা বনমালী ভৌমিক অনেকটা কর্তৃত্ববাদী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে রেখেছিলেন। উপাচার্য শিক্ষা ছুটিতে বিদেশ থাকার সুযোগে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য পদে নিজেই আসীন হয়ে স্থাপত্য বিভাগের দুই শিক্ষককে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করেছিলেন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে শেষে উপাচার্য দেশে ফেরেন।
অভিযোগ ওঠে, উপাচার্যকে নাজেহাল করতে একের পর এক নির্দেশনা জারি করেন কোষাধ্যক্ষ বনমালী। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দুই শিক্ষককে বহাল রেখে উপাচার্যের কর্মপরিবেশ দিতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই সঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে ভারতীয় নাগরিকসহ দুজনকে দুই মাসের মধ্যে বাদ দিয়ে নতুন করে বোর্ড গঠনেরও নির্দেশনা দিয়েছিল। গত বছরের নভেম্বর মাসে এই নির্দেশনা দেওয়া হলেও প্রায় ৯ মাসেও তা মানেননি কোষাধ্যক্ষ বনমালী ভৌমিক। উল্টো তিনি উপাচার্যের কক্ষ তালা দিয়ে রেখেছেন।
গেল বছরের ১২ নভেম্বর ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, সাম্প্রতিক সময়ে লিডিং ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন অনিয়ম এবং বিশ্ববদ্যিালয়টির উপাচার্য এবং বিওটির চেয়ারম্যানের পরস্পরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ তদন্তে গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ি, লিডিং ইউনিভার্সিটি স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক স্থপতি সৈয়দা জারিনা হোসেইন এবং সহযোগী অধ্যাপক স্থপতি রাজন দাশের বরখাস্ত আাদেশ ঘোষণাপূর্বক সকল সুযোগসুবিধাসহ তথাকথিত বরখাস্ত আদেশের স্বাক্ষরের তারিখ হতে স্বপদে পূর্নবহাল করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। সেইসঙ্গে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০ এর কোনো এখতিয়ার বলে তাদের চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে তার কারণ দর্শানোসহ ব্যাখ্যা তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনে পাঠাতে হবে।
ভারতীয় নাগরিক সাদিকা জান্নাত চৌধুরী ও নাবালক সাইদ আজমাইন আবদুল হাইকে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ থেকে বাদ দিয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা ও আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টির অনিরীক্ষিত অর্থবছরের নিরীক্ষা করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক কাজী আজিজুল মাওলাকে চুক্তি অনুযায়ী বেতনভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাদি দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ইউজিসির পরিচালক ওমর ফারুক স্বাক্ষরিত চিঠিতে সব বিভাগে তিন মাসের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রয়োজনীয়সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর ৩৩(৩) ধারা মোতাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা নিশ্চিত করার জন্যও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কাজী আজিজুল মাওলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ ট্রাস্টি বোর্ড ১৭ বছর ধরে সরকারের স্থায়ী অনুমোদন না থাকা এবং লিডিং ইউনিভার্সিটিতে ট্রেজারার বনমালী ভৌমিকের দুর্নীতি নিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে ইউনিভার্সিটির ব্যাংক হিসাবে ৬৮টি লেনদেনে অনিয়মের বিষয়ে জানতে রেজিস্ট্রার বরাবরে ইউজিসির দেওয়া চিঠিসহ ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সাদিকা জান্নাত চৌধুরী (পাসপোর্ট নং-ক৩৯২০৮৫০) ভারতের নাগরিকের বিষয়টি উল্লেখ করেন।
ইউজিসির নির্দেশনার বিষয়ে গত বছরের ১২ নভেম্বর লিডিং ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার মো. মফিজুল ইসলাম ‘চিঠি পাইনি’ বলে খবরের কাগজকে এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইউজিসি এমন কোনো আদেশ দিয়ে থাকলে তাহলে যতটুকু পালন করার ততটুকু করা হবে। আর যেটুকু আমরা পালন করতে পারব না, সেটা ইউজিসিকে যথারীতি জানিয়ে দেওয়া হবে।’
প্রায় ৯ মাসের মাথায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে স্পষ্ট বিবৃতি সম্পর্কে শনিবার ফোনে যোগাযোগ করলে রেজিস্ট্রার মফিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ রকম কিছু তিনি পাননি।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুই শিক্ষককে ভিন্ন দুটো কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত আদেশ দেখিয়েছিল। স্থপতি জেরিনা হোসাইন গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর তার শিক্ষকতার চুক্তি বর্ধিত করার আবেদন করেছিলেন। এটি উপাচার্য মঞ্জুর করলেও সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনহীন দেখিয়ে চিঠি দিয়ে তার চাকরির মেয়াদ শেষ বলা হয়। অন্যদিকে, স্থাপত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান স্থপতি রাজন দাশকে পেশাগত অসাদচরণের অভিযোগ তুলে গত বছরের ৯ অক্টোবর কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তার ই-মেইল আইডিতে পাঠানো নোটিশ দেখে তিনি জবাব দিতে সময় চেয়ে ই-মেইলে আবেদন করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সময় না দিয়ে ১২ অক্টোবর আরেকটি ই-মেইল দিয়ে বরখাস্ত আদেশ পাঠান।
এতে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০তম সিন্ডিকেট সভায়। এ বিষয়টি আবার লিডিং ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের ২৩তম সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয় বলে জানানো হয়।
স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা গত ১৫ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে জানতে পারেন। এ সময় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ‘আমাদের স্যার কই, ম্যাম কই’ প্লেকার্ড প্রদর্শন করে দুই শিক্ষককে বহালের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দুই শিক্ষককে হঠাৎ বরখাস্ত করার সময়ে লিডিং ইউনিভার্সিটির উপাচার্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন। ট্রেজারার বনমালী ভৌমিক ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে এ কাজটি করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভিডিও বার্তায় উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত আইনসম্মত নয় বলে জানালে শিক্ষার্থীরা দুই শিক্ষককে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেরাতে আন্দোলন করছেন।
উজ্জ্বল মেহেদী/অমিয়/