রোহান বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বলতে গেলে চোখের মণি। সবে এসএসসি শেষ করে ঢাকার একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনায় ভালো। একমাত্র সন্তান হওয়ায় বাবা-মা তার কোনো কিছুর কমতি রাখেনি। কলেজে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় বন্ধু সার্কেলও গড়ে উঠেছে। সবার মধ্যে গলায় গলায় ভাব।
একদিন তার কাছের এক বন্ধু আড্ডার ফাঁকে তাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলল দুটান দিতে। বড্ড জোরাজুরি করায় বন্ধুর অনুরোধ রাখতে গিয়ে রোহান সেই যে দুটান দিল, অমনি নেশাটা তার হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়াল। পাশাপাশি আরও বিভিন্ন রকম নেশা নেওয়া শুরু করেছে রোহান। নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে এখন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। পাশাপাশি তার পড়াশোনাও অবনতির দিকে।
ওপরের ঘটনাটি নিছক গল্প হলেও এটা এখন বর্তমান টিনএজারদের মধ্যে অহরহ ঘটছে। স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে সদ্য কৈশোর পেরিয়ে এখন অনেকে পা রেখেছে কলেজে। নতুন আঙিনায় নতুন মানুষের সান্নিধ্যে এটাই এখন তাদের এগিয়ে যাওয়ার সময়। কিন্তু এই সময়ে তাদের মনে উঁকি দেবে নানান কিছু। বাসা বাঁধবে হরেক রকম জল্পনাকল্পনা। এই জল্পনাকল্পনার মধ্যে অন্যতম হলো মাদকজাত দ্রব্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নেশার জগতে পা রাখার প্রথম সিঁড়ি হলো ধূমপান। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। বলতে গেলে ধূমপান থেকেই মাদকের হাতেখড়ি। মাদকাসক্তি বলতে মানুষের তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ধরনের মাদক, যেমন- ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলের প্রতি আসক্ত হওয়াকে বোঝায়। যা সেবনের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যক্তিটি পুনরায় গ্রহণ করতে উৎসাহিত হয় এবং আস্তে আস্তে তা বদঅভ্যাসে পরিণত হয়। তবে সবচেয়ে অনুতাপের বিষয়- এই জঘন্য আসক্তিটি তখনি জন্মে যখন মাদক নামক বস্তুগুলোর সহজলভ্যতা থাকে কিংবা আশপাশে কেউ সেবন করে।
বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা নানানভাবে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে উন্নত দেশগুলো এই মাদক নামক যন্ত্রণা থেকে কিছুটা হলেও নিস্তার পেয়েছে। কারণ মাদক নিয়ে তাদের কঠোর নীতি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণা জনগণকে মাদক থেকে দূরে রাখতে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি মাদক নির্মূলে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, মাদকের চিত্র কতটা ভয়াবহ। রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাদক ঢুকে শেষ করে দিচ্ছে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
মাদকের প্রতি কঠোর হয়ে কিছু দেশ পরিত্রাণ পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের কথা। ভয়াবহভাবে মাদক বিস্তার করেছিল এসব দেশে। মাদক থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় না পেয়ে মাদকসেবনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান কার্যকর করলে নিমিষেই মাদকের প্রভাব কমে আসে। ফলে বর্তমানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সুন্দর দেশে পরিণত হয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে ৭০ লাখের ও বেশি মানুষ মাদকাসক্ত। যেখানে আবার অর্ধেকেরও বেশি ইয়াবায় আসক্ত। ইয়াবা এখন দেশের তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে। ইয়াবা মূলত তৈরি করে মিয়ানমারের ওয়া এবং কোকাং সম্প্রদায়ের লোকেরা। বাংলাদেশের পূর্বে রয়েছে গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেল। যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হেরোইন উৎপাদন করা হয়। আর পশ্চিমে রয়েছে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট। মূলত এই অঞ্চলগুলো বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার লাভ করতে সাহায্য করেছে। ধ্বংস করছে দেশের সোনালি প্রজন্মকে।
বাংলাদেশকে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা সে মাদকগুলো যেমন সারা বিশ্বে পাচার করছে। ঠিক তেমনি এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও ছড়িয়ে দিচ্ছে। মাদককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের গ্যাং বা গোষ্ঠী। আবার যেখানে এসব গ্যাং বা গোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্য হলো কিশোর। এসব কিশোরকে কিছু মানুষ নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছে প্রতিনিয়ত। তবে আশার বিষয়, আমাদের দেশে ২০১৪ সালের মাদক সংশোধিত আইনটি সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল আইন। এটা আগামীর তরুণ প্রজন্মকে অন্ধকারে আশার আলো দেখাচ্ছে। দেশে মাদকের বিরুদ্ধে চলমান কর্মসূচিগুলো কিছুটা হলেও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন লোকদের মনে ভীতি তৈরি করতে পেরেছে।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক মাদক নির্মূলকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। তবে বর্তমান প্রজন্মকে মাদকবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে সচেতনতা তৈরি করতে পারলে মাদকের ব্যবহার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে একটি জরিপ চালায়। সে জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধূমপায়ী এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। যা নিঃসন্দেহে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজি অর্জন এবং সুস্থ জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি মাদকের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে কিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালাতে হবে। যার ফলে আমরা পাব একটি সুশৃঙ্খল সুন্দর মাদকমুক্ত লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
কলি