রক্তাক্ত জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর এতে যুক্ত হন সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। দিন যত গড়াতে থাকে আন্দোলনের তীব্রতা তত বাড়তে থাকে। আন্দোলন রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। তৎকালীন সরকারের কূট চাল ও চাপে যখনই আন্দোলন স্তিমিত হয়েছে, তখনই সারা দেশের স্কুল-কলেজ-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে এসেছেন রাজপথে। তারাই আন্দোলনে সঞ্চার করেছেন নতুন প্রাণের।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ করেন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা। তারা দাবির চূড়ান্ত সুরাহার সময়সীমা বেঁধে দেন ৪ জুলাই পর্যন্ত।
২ জুলাই শাহবাগ এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন তারা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২০ মিনিট ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা।
তারা আবার ৩ জুলাই শাহবাগ মোড় দেড় ঘণ্টা অবরোধ করেন। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে আরও ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে অংশ নেন। ৪ জুলাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ স্থগিত করেননি।অব্যাহত থাকে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন। এদিন বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা মেধার মূল্যায়ন চেয়ে একযোগে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ সময় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, খুলনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে দাবি আদায়ের শপথ নেন। আন্দোলনের কারণে রাজধানীতে তীব্র যানজট দেখা দেয়।
৫ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন। ৬ জুলাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ডাকা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিতে ৭ জুলাই স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। তাদের পক্ষ থেকে আসে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা।
এরপর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দিনগুলো অতিবাহিত হতে থাকে। রাষ্ট্রপতির কাছে তারা স্মারকলিপি দেন ১৪ জুলাই। সেই দিনই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। এর জেরে মধ্যরাতেই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। হামলা হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর।
১৬ জুলাই বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ ৬ জন। আবু সাঈদকে পুলিশের গুলি করার ভিডিও সব গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারের নির্দেশে অর্নিদিষ্টকালের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। এরপর সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল বন্ধের ঘোষণা আসতে থাকে। আন্দোলনকারীরা ১৭ জুলাই বিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ, গায়েবানা জানাজা, কফিন মিছিল করেন।
তবে এই দিনেই প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করে সরকার। এতে করে আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে দেখা দেয় শঙ্কা। এরপরও আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়কের পক্ষ থেকে ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ঘোষণা আসে।
তবে এদিন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দিনভর ছিল ফাঁকা। প্রবেশমুখগুলোতে পাহারায় ছিল পুলিশ। ফাঁকা ক্যাম্পাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ চিত্র দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছিল শিক্ষার্থীশূন্য। সরেজমিনে দেখা যায়, নীলক্ষেত, শাহবাগ, পলাশী, চানখাঁরপুল, বকশীবাজারসহ ঢাবির প্রবেশমুখগুলোতে ব্যারিকেড বসিয়ে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। পুরো এলাকায় ছিল নীরবতা। দেখা যায় বিভিন্ন হলের কর্মচারীদের অলস সময় পার করতে।
অপর দিকে এই দিনে সর্বাত্মক কমপ্লিট শাটডাউন পালনে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নেমে আসেন। বিশেষ করে আন্দোলনের চলমান দিনগুলোতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি রাজপথে না থাকলেও, তাদের সমর্থন ছিল। সেটাই চোখে পড়ে ১৮ জুলাই। একযোগে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজপথ নিজেদের দখল নেন। পালিত হয় সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি। এই দিনে দেশব্যাপী সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত হন ৩১ জনের ওপরে। সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব এলেও আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিনে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালনের জন্য সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধানমন্ডি, উত্তরা, মিরপুর, বাড্ডা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক জমায়েত দেখা যায়। একই সঙ্গে এ সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় অবস্থান নেন। এদিকে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সড়ক থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় পুলিশের। এতে আক্রান্ত হন রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্কুল, কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকায় সকাল ৯টার দিকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বেসরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন স্লোগানে বিক্ষোভ করতে থাকেন। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেরুল-বাড্ডা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। তাদের সঙ্গে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন।
অবরোধের কারণে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরে যেতে বলে। এতে বাগবিতণ্ডায় জড়ায় দুই পক্ষ। পরে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দিতে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে সংঘর্ষে যোগ দেন স্থানীয় যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। দীর্ঘ ৪ ঘণ্টার সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। তারা ভেতরে চলে গেলেও গেটের ফাঁক দিয়ে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সড়কে অবস্থান করছিলাম। পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে এবং গুলি চালায়। এতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত ও নিহত হয়েছেন। চলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর নজিরবিহীন হামলা ও পুলিশের গুলি।
রাজধানী ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় ১৮ জুলাই দিনভর বিক্ষোভ, অবরোধ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, পুলিশের হামলা-গুলি ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দেড় হাজার ব্যক্তি ও নিহত হন অনেক। কোথাও কোথাও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের, আবার কোথাও সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এই দিনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা লাভ করে। এরপর সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে কারফিউ জারি করে সরকার।
এরপর আন্দোলনের গতি পথ থমকে যায়। শিক্ষার্থী ও বিরোধী মত দমনে সারা দেশে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চিরুনি অভিযান। এর মধ্যেই নানাভাবে সমন্বয়করা আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
২৮ জুলাই রাতে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজতে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহরের ঘোষণা দেন। তবে বাহিরে থাকা সমন্বয়করা অভিযোগ করেন, চাপের মুখে কর্মসূচি প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছেন। এর প্রতিবাদে ২৯ জুলাই সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেন।
আবার রাজপথে নেমে আসেন স্কুল-কলেজ-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ সারা দেশেই তারা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপর আসে সরকার পতনের এক দফা দাবি। ৩৬ জুলাই অর্থাৎ ৫ আগস্ট পর্যন্ত এসব শিক্ষার্থীরা রাজপথে থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি বাস্তবায়ন করেন। অর্জিত হয় দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
কলি