ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) দলীয় ছাত্ররাজনীতি একেবারে নিষিদ্ধ চান শতকরা ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া দলীয় ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাশা করেছেন শতকরা ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। দশমিক ২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায়ই প্রত্যাশা করেছেন। সর্বমোট শতকরা ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটি রিসার্চ সোসাইটির উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ঢাকা সাংবাদিক সমিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক কার্যক্রম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত’ শীর্ষক প্রকাশিত ওই গবেষণায় এসব তথ্য উঠে আসে।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, শতকরা ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতির কোন ‘গুরুত্ব নেই’ বলে মনে করেন। সর্বমোট ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। এর মধ্যে ৭১ শতাংশ খুবই নেতিবাচক প্রভাব ও ২৫ শতাংশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। এর বিপরীতে ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে মনে করেন। যার মধ্যে ১ শতাংশ খুবই ইতিবাচক প্রভাব ও ২ শতাংশ ইতিবাচক প্রভাব বলে মনে করেন। ১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন দলীয় ছাত্ররাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না।
গবেষণা জরিপে, দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিকল্প হিসেবে দেখছেন গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা। এতে ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নিয়মিত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন এর পক্ষে মত দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও দলীয় ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘শুধুমাত্র ছাত্রসংসদ চান, তবে দলীয় ছাত্ররাজনীতি চান না’ বলে মতামত দিয়েছেন।
ওই গবেষণা জরিপটিতে ছাত্ররাজনীতির মূল প্রভাব হিসেবে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্ষমতার অপব্যবহারকে উল্লেখ কর হয়। ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক চাপ, ৮৪ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ভয়ংকর গেস্টরুম কালচার, ৭৭ দশমিক ২ শতাংশ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংতা, ৭৪ দশমিক ১ শতাংশ দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থতা, ৬৮ দশনিক ৭ শতাংশ জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাব, ১১ দশমিক ৪ শতাংশ নেতৃত্বে সুযোগ সৃষ্টি, ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি এবং ৪ দশমিক ৫ শতাংশ অন্যান্য প্রভাব উল্লেখ করা হয়েছে।
জরিপের ফলাফলে আরও দেখা যায়, ক্যাম্পাসভিত্তিক বা হলভিত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতির কমিটি প্রদানকে ৯৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সমর্থন করেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতির সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং সমর্থন করেন কি— প্রশ্নে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন; অর্থাৎ, ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতির সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং সমর্থন করেন না। ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে তাদের শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া দলীয় ছাত্ররাজনীতি পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা ৫৯ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনেশিক্ষার্থী ‘খুবই অসন্তোষজনক’, ২৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘অসন্তোষজনক’, ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘মধ্যম’, ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘সন্তোষজনক’ এবং ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ‘খুবই সন্তোষজনক’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি প্রকৃত অর্থেই জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম নয় বলে মনে করেন ৮৭ শতাংশ শিক্ষার্থী।
রাজনৈতিক কার্যক্রমের ফলে ৭৪% শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা আছে বলে উল্লেখ করেন, অপরদিকে মাত্র ২৬% শিক্ষার্থীর নেতিবাচক অভিজ্ঞতা নেই বলে মতামত প্রকাশ করেন। ৯০% শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন না। এ জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৬% শিক্ষার্থী কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই (জরিপে অংশগ্রহণকালীন সময়ে) বলে জানিয়েছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো দলীয় ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাশা করে না, এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, “পূর্বের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা বিশেষত নির্যাতন ও নিপীড়নজনীত অভিজ্ঞতা (গণরুম ও গেস্টরুম কালচার, টর্চার সেল, জোরপূর্বক রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং এ অংশগ্রহণ করানো ইত্যাদি)। দলীয় ছাত্ররাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়া, শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী ৪টি সুপারিশ করা হয়। সেগুলো হলো— দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধকরণ; ডাকসু পুনর্জীবিত ও সংস্কার; শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কমিটি গঠন; শিক্ষা ও গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত।
এর আগে, গত ৩ সেপ্টেম্বর গবেষণা জরিপ চালায় সংগঠনটি। পরে এটি শেষ হয় ১১ সেপ্টেম্বর। এই জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৮টি বিভাগ ও ১০টি ইনস্টিটিউটের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ২ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। গবেষণাটি পরিচালনার জন্য পরিমাণগত (কোয়ান্টিটিভ) পদ্ধতি এবং গবেষণা পরিকল্পনা (রিসার্চ ডিজাইন) হিসেবে ক্রস সেকশনাল সার্ভে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে।
দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধে ফের বিক্ষোভ মিছিল: ঢাবিতে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং অনতিবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের দা দাবিতে লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। গেল কয়েকদিন ধরে ‘দলীয় রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস আন্দোলন’ ব্যানারে ক্যাম্পাসে দলীয় উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করে এসেছেন।
মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে শিক্ষার্থীরা একে একে জড়ে হতে থাকেন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা স্মৃতি চিরন্তন হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। এতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা জানান, পরবর্তীতে তাদের কর্মসূচি জানিয়ে দেওয়া হবে।
সন্ধ্যায় পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি এণ্ড লিডারশীপ বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আপাতত হলগুলোতে জনসংযোগ করবো। প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি জানানো হবে।’
আরিফ জাওয়াদ/এমএ/