আজ ৩ ডিসেম্বর- ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’। ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই দিবসটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবন্ধীরা আজও সমাজে অবহেলিত ও নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও হতাশাজনক। সমাজে প্রতিবন্ধীদের সমস্যা ও সমাধানের উপায় নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিমত তুলে ধরেছেন শাহ্ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ
‘সীমাবদ্ধতা মানেই হেরে যাওয়া নয়’
দীপা সাহা প্রিয়া
আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটা শুনলেই মানসপটে ভেসে ওঠে সমাজে পিছিয়ে পড়া একাংশের চিত্র, যারা জীবনমান উন্নয়নের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন।
‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ অনুসারে, মোট সাত ধরনের প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, যা দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ।
একটি সাদা জামায় তিল পরিমাণ কালির দাগ যেমন সম্পূর্ণ জামাটার দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে কলুষিত করে, সেই রকম প্রতিবন্ধকতার ধরন যাই হোক না কেন, প্রকট কিংবা প্রচ্ছন্ন- তা প্রতিবন্ধী ট্যাগধারী ব্যক্তিটিকে সামাজিক মানদণ্ডের পাল্লায় স্বাভাবিক জগৎ থেকে নির্বাসিত করে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেখা হলেও মূলত তারা তাদের অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তথাকথিত সামাজিক স্বীকৃতির অভাব ও সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে প্রতিবন্ধীদের শৈশব হারিয়ে যায় না, বরং নষ্ট হয়!
সামাজিক বর্জন ও অবহেলা, উপযুক্ত শিক্ষা ও বিকাশের অভাব, কর্মসংস্থানের অপর্যাপ্ততা, ভৌত ও অবকাঠামোগত অপ্রাপ্যতা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসনের অপ্রতুলতা প্রভৃতি তাদের জীবনমান উন্নয়নের অন্তরায়। অবাক করা তেতো সত্য, একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে দাঁড়িয়েও বিপুল জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগের অন্যতম কারণ প্রচলিত কুসংস্কার। পদ্মা, যমুনা, মেঘনার বহু পানি গড়িয়েছে- এমনকি উন্নয়নের দরুন নদীগুলোর নাব্য হারিয়ে পানিশূন্য খাল হওয়ার উপক্রম। তবুও এখনো কানা, খোঁড়া, ন্যাংড়া, বোবা, পাগল বলে অভিহিত করে তাদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয়।
‘সীমাবদ্ধতা মানেই হেরে যাওয়া নয়, বরং ভেতরের অদম্য শক্তি অনুসন্ধানের সুযোগ।’ কাজেই প্রতিবন্ধকতা কোনো অপরাধ নয়; প্রতিবন্ধীরা নয় পাপের ফসল। নিজেকে প্রমাণের উপযুক্ত সুযোগ পেলে তারাও দক্ষ জনশক্তি হয়ে উঠতে পারে, সভ্যতার কল্যাণে স্বাক্ষর রাখতে পারে।
‘তারা করুণা চায় না, চায় সুযোগ’
মো. এমরান হোসেন
সমাজকর্ম বিভাগ
‘প্রতিবন্ধী’ শব্দটা শুনলে জানি না কেন অধিকাংশ মানুষের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও সংস্থা এখন ‘প্রতিবন্ধী’ শব্দের জায়গায় ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন’ ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। এতে কি আদৌ অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন আসে?
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনো সমাজে অবহেলিত, তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু কেন জানি না প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা এলে সবাই চুপ হয়ে যায়। তাদের অধিকার নিয়ে বেশির ভাগ মানুষ কথা বলতে চায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিনে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যে নামমাত্র ভাতা দেওয়া হয়, তা দিয়ে এক বস্তা চালও কেনা কঠিন। দেশের যানবাহন থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ যথেষ্ট প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। উচ্চশিক্ষার জন্য অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই দৃষ্টি ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য তাদের উপযুক্ত শিক্ষা সরঞ্জাম। দেশের বিশাল বিশাল ভবনের বেশির ভাগে নেই প্রতিবন্ধীদের সহজে যাতায়াতের ব্যবস্থা। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য নেই যথেষ্ট অনুদান ও সাহায্যের ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ (ক) অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ এ দেশের সব নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই অনুচ্ছেদের যথাযথ সমতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৪৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার।
আমাদের প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। কারণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৈষম্যের উৎপত্তি এবং বৈষম্য থেকে জনবিচ্ছিন্নকরণ।
পরিশেষে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও পারে, তাদেরও রয়েছে দেশ ও জাতি গঠনের ক্ষমতা ও প্রতিভা। তাদেরকে যথেষ্ট সুযোগের ব্যবস্থা করে দিন।
প্রতিবন্ধীদের জন্য চাই যুগোপযোগী শিক্ষা
মো. আতিক শাহরিয়ার সিয়াম
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জন্মের পর থেকেই প্রতিবন্ধীরা প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হয়। স্কুলজীবন প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এক আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয়। বুলিং থেকে শুরু করে অসংখ্য বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হতে থাকে প্রতিবন্ধী শিশু। অনেক স্কুল তো প্রতিবন্ধীদের ভর্তিই নেয় না।
প্রতিবন্ধীরা সব নিগ্রহের জবাব নীরবেই দিতে পারত শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু আফসোস, প্রতিবন্ধীদের জন্য যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা দেশে গড়ে ওঠেনি। ইউনিসেফের সহায়তায় করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জাতীয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জরিপ ২০২১’ অনুযায়ী দেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের ৬০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে। অথচ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এমপিওভুক্ত স্কুল আছে মাত্র ৭৬টি। সে স্কুলগুলোরও আবার বেহাল। অথচ মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার ৬৯৭টি প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন ঝুলে আছে ২০১৯ সাল থেকে। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এই অবহেলা সব ক্ষেত্রে। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিবন্ধীদের অধিকার- যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ২৩ নং অনুচ্ছেদ দ্বারা স্বীকৃত। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর ১৬ নং ধারায় বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংহত করার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গী করে নিতে পারলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও গতিশীল অর্থনীতির স্বপ্ন পূরণ সহজতর হবে।
আমাদের দেশ ও বিশ্ব প্রতিবন্ধীবান্ধব হোক। এটাই এবারের বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের চাওয়া।
প্রতিবন্ধী হওয়াটা লজ্জার নয়
মো. আরিকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ
প্রতিবন্ধী শব্দটাকে বর্তমানে সমাজে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেওয়া এক লজ্জার বিষয়।
প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্মান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমাদের সর্বপ্রথম কাজ হলো চিন্তাধারার উন্নতিসাধন করা। প্রতিবন্ধীদের কোনো সময় বুঝতে দেওয়া যাবে না তাদের সীমাবদ্ধতা। ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’- এ মন্ত্রটি বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রতিবন্ধীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে, শ্রেণিকক্ষে কটাক্ষের শিকার হতে হয়। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতিসাধন করছে। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের সঙ্গে সর্বদা সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে।
সঠিক মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে ‘হেলেন কেলার’ হয়ে উঠেছিলেন ‘অন্ধকারে আলো জ্বালা এক দীপশিখা।’ তার শিক্ষক অ্যানি সুলিভানের স্পর্শ-অনুভূতির মাধ্যমে শিক্ষাদান এটাই প্রমাণ করে, জীবনের চাকা যদি একপাশে থেমে যায়, তবে অন্যপাশে ঘুরিয়ে দিতে হয়। যার সুদূরপ্রসারী প্রতিফলন দেখা যায় দৃষ্টিহীন নাহিয়ান বুশরার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিকূলতা জয়ের চ্যালেঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাশ করা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শাহীন আলম স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার ব্যবহার করে কম্পিউটারের সব কাজ করেন। নিজের মতো অন্য যারা প্রতিবন্ধকতার জীবন পার করেছেন তাদের জন্যও যেন তিনি আশীর্বাদ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছেন। চোখের আলো নেই, এমন প্রায় অর্ধশত দেশি-বিদেশি মানুষ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তার কাছে।
হাসান