তীব্র ইচ্ছেশক্তিই যেন দৃষ্টিশক্তিহীন মো. শাহীন আলমের এগিয়ে চলার মূলমন্ত্র। জীবনে যার প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বহু, তবু পর্বত জয় করতে তিনি মরিয়া। আলোহীন চোখ নিয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। করেছেন ভালো ফলাফলও। পরিতৃপ্তির দিক হলো, তিনি লিখতে পারেন। বেশ দক্ষতার সঙ্গে কম্পিউটারের নানাবিধ কাজ করেন ঝিনাইদহের এই মেধাবী মুখ। স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার ব্যবহার করে তিনি কম্পিউটারের সব কাজ করেন। নিজের মতো অন্য যারা প্রতিবন্ধকতার জীবন পার করেছেন তাদের জন্যও যেন তিনি আশীর্বাদ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে পারদর্শী করে তুলেছেন। চোখের আলো নেই, এমন প্রায় অর্ধশত দেশি-বিদেশি মানুষ কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তার কাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের এই গ্র্যাজুয়েট বর্তমানে নিজস্ব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শুরু করার চেষ্টায় আছেন। কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে।
জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে শাহীন বলেন, ‘আমারও তো ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শেষ করে সম্মান নিয়ে বাঁচার, ভালো একটা চেয়ারে বসার। কিন্তু আমি তা পারিনি। জীবনের কঠিনতম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছি। রাষ্ট্র আমাকে তুলে নেয়নি। সুযোগ দেয়নি উঠে দাঁড়ানোর। আমাদের অধিকার কি শুধু এতটুকুই? নিজ যোগ্যতাবলেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। কিন্তু কোনো বিশেষ সুবিধা না থাকায় আমার পরবর্তী গন্তব্য অচেনা, দুরূহ।’
বেদনা কাতর স্মৃতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও অনেক অভিজ্ঞতার সনদ অর্জন করেছি। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া, কল সেন্টারে কাজ করা, কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, বেসরকারি সংস্থায় ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা অন্যতম। কিন্তু এখন এসব দক্ষতা শুধু অর্জন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। প্রায়োগিক ক্ষেত্র খুঁজে পাইনি।’
এই মেধাবী মুখ জন্মলগ্ন থেকেই দৃষ্টিহীন ছিলেন না। বরং পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালীন ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় চিরতরে তার চোখের আলো নিভে যায়। দৃষ্টি হারানোর সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি হাতড়িয়ে তিনি জানান, ‘আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১২ বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ি। অনেক চেষ্টার পর দৃষ্টিহীনদের বিদ্যালয় খুঁজে পেতে সক্ষম হই। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলায় অবস্থিত। সেখান থেকে ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হই। এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।’
শাহীন আলম মাধ্যমিক শেষ করার পরই মুখোমুখি হন জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার। পরিবার থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে একাই চালিয়ে নেন নিজের পড়ার সব ব্যয়ভার।
শাহীন বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন জীবনটাকে গুমোট বাঁধা অন্ধকার গুহার মধ্যে ঠেলে দিলাম। বাবা তখন প্রবাসে থাকতেন। উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার বিষয়ে বাবাকে জানালে খরচ সম্পর্কে জেনে কোনো কিছু চিন্তা না করে আমাকে স্রেফ জানিয়ে দেওয়া হলো, ‘তোমার পড়াশোনা করার দরকার নেই। তুমি পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে কী করবে? বাবাকে কোনোভাবেই বোঝাতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলাম, যত ঝড়ই আসুক, পড়াশোনা আমি করবই। বাবার কাছ থেকেও কোনো খরচ নেব না।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষা উপবৃত্তির জন্য মনোনীত হলাম। তবু প্রতি মাসে আমার শিক্ষা উপবৃত্তির ২ হাজার টাকা দিয়ে কলেজে যাওয়া-আসার যানবাহন ভাড়া মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ব্রেইল উপকরণ কেনা, বই কেনা, রেকর্ডিং খরচ, টিউশন ফি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরে ঢাকায় চলে এসে ছোট একটা কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে নিই। সঙ্গে মাঝে মধ্যে সুযোগ করে পাশাপাশি কম্পিউটার চালানো ও টিউশনি করতে থাকি। এতে যা উপার্জন হতো তা দিয়ে আমার লেখাপড়ার খরচ, বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য খরচ কোনোরকম মেটাতাম।'
উচ্চশিক্ষার স্তরেও কষ্টের স্মৃতি তার নিত্যকার সঙ্গী ছিল। নিজের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শাহীন বলেন, ‘অনেক কষ্টের পর ২০১৫-১৬ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। আবার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাসিক শিক্ষা উপবৃত্তির জন্য মনোনীত হলাম। সেই শিক্ষা উপবৃত্তির ২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে প্রতি মাসে কোনো রকমে টেনেটুনে চলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন।’
তিনি যোগ করে বলেন, ‘তবে স্বল্প শিক্ষাবৃত্তির অর্থ দিয়ে চলা কষ্ট হওয়ায় সেখানেও মাস্টারদা সূর্যসেন নিজের কক্ষে প্রিন্টিং ও মোবাইল অ্যাক্সেসরিজের ব্যবসা শুরু করেছিলাম। মাঝে মধ্যে হকারের বেশে মোবাইল অ্যাক্সেসরিজ নিয়ে মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ফটোকপি দোকানের পাশে বিক্রি করতে বসতাম। এতে যা উপার্জন হতো তা দিয়েই আমার লেখাপড়া ও অন্যান্য খরচ মেটাতাম।’
শাহীন আলম আরও বলেন, ‘এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে অনার্স এবং ২০২৩ সালে মাস্টার্স শেষ করলাম। কিন্তু আমার যে স্বপ্ন তা অঙ্কুরেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ২০১৮ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দিলে প্রতিবন্ধী কোটাও বাতিল হয়ে যায়।’
সরকারি চাকরিতে সুযোগ না পেলেও বসে থাকেননি তিনি। দৃষ্টিহীনদের জন্য নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র। নিজের অবদানের কথা উল্লেখ করে শাহীন বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত বাংলাদেশের এবং ভারতের ৩৫০ দৃষ্টিহীন মানুষকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে ৪৫ জন বাংলাদেশি এবং ভারতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। কম্পিউটার পরিচিতি ও ইতিহাস, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার ব্যবহারবিধি, অফিস প্রোগ্রাম পরিচিতি, মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, মাইক্রোসফট এক্সেল, মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট, ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ের বেসিক বিষয়গুলো আমরা প্রাথমিকভাবে শিখিয়ে দিই।’
শাহীন বর্তমানে যে কম্পিউটারের মাধ্যমে অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তা অনেক পুরোনো, ভালোভাবে কাজ করতেও অসুবিধা হয়। এ ছাড়া রয়েছে অন্যান্য সরঞ্জামেরও অভাব। রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে দৃষ্টিহীন মানুষের জন্য আবেদন জানিয়ে শাহীন বলেন, ‘আমাদের মৌলিক অধিকারটুকু নিশ্চিতে নজর দিতে হবে। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দুর্বল ও অবহেলিত শ্রেণির মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুবই জরুরি।’ নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা করে শাহীন বলেন, ‘আমি প্রত্যাশা রাখি, বাংলাদেশের একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আসবে। দেশের সব মানুষ মিলে কাজ করলে আমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।’
হাসান