রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ১০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ টিনশেড বাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অস্থায়ী আবাসনের জন্য বিনামূল্যে এসব জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হলেও, তারা এর বাইরে জায়গা দখল করে বস্তি গড়ে তুলেছেন।
এসব বস্তি বহিরাগতদের ভাড়া দিয়ে কর্মচারীরা নিয়মিত আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার বরাদ্দ পাওয়া কর্মচারীরা বহিরাগতদের সাবলেট দিচ্ছেন। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। বহিরাগতদের অবাধ বিচরণে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন অবৈধ বস্তি উচ্ছেদে উদ্যোগ নিলেও তিন মাসেও তা কার্যকর হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, অবৈধ বস্তি ও ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ হবে কবে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব উপাচার্যের আমলেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পছন্দের কর্মচারীদের বিনামূল্যে অস্থায়ীভাবে এসব জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কর্মচারীরা তার বাইরে অতিরিক্ত জায়গা দখল করে ঘর বানিয়ে সেগুলো বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা, মুসলিমপাড়া ও মিনিবাজারের পেছনের এলাকায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ২৫০ জন কর্মচারী তাদের জন্য বরাদ্দ জায়গার বাইরে অতিরিক্ত জায়গা দখল করে টিন দিয়ে অস্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যেখানে প্রায় ১৮০টি বহিরাগত পরিবার ভাড়া রয়েছে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বরাদ্দ পাওয়া প্রায় প্রতিটি কর্মচারীই তাদের বরাদ্দ করা বাড়িতে রুম সাবলেট দিয়ে অবৈধ আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। ক্যাম্পাসটিতে এখন প্রায় ৩০০ বহিরাগত পরিবার বসবাস করছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত প্রশাসন। সে সময় ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ এবং অবৈধভাবে দখল করা সব স্থাপনা ও জমি ছেড়ে দেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবৈধভাবে ভাড়া থাকা ৩০০ পরিবারের মধ্যে ২১০টি পরিবার ক্যাম্পাস ত্যাগ করেছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাকিদের ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য নির্দেশ দিলেও এখন পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।
এর আগে ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ উন্নয়নে তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সেকেন্দার আলীর নেতৃত্বে ২৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটির সভায় বস্তি ও ভাড়াটিয়াদের এক মাসের মধ্যে বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নোটিশে সময়সীমা অতিক্রম করলে পানি ও বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্নসহ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। তবে সে সময় ৪০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৫০টি পরিবার ক্যাম্পাস ছাড়ে।
কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী হাবীবুর রহমান বলেন, ‘প্রশাসন এক মাসের মধ্যে এসব উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অথচ তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে। যারা অনিয়ম করছেন তাদের কেন এত সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, সেটাই আমরা বুঝি না।’
অবৈধ এসব ভাড়াটিয়া ও বহিরাগতদের অবাধ বিচরণে ক্যাম্পাস মাদক ও চোরাচালানের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। এতে কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে, যা শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ব্যাহত করছে। বিভিন্ন সময় এসব বস্তি থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা প্রহরীরা আটক করেছেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ও চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ১৬ জনের নাম উঠে আসে, যাদের মধ্যে ৫ জন বস্তির, ৩ জন বহিরাগত এবং ৯ জন কর্মচারী। এরা বস্তি থেকে শিক্ষার্থী ও আশপাশের এলাকায় ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ মাদক সরবরাহ করত।
২০১৮ সালের কলেজগেট এলাকা থেকে র্যাব-৪ মো. বাবু নামের একজনকে ২২৫ পিস ইয়াবা ও নগদ টাকাসহ আটক করে, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তিতে ভাড়া থাকতেন। একই বছরের ২ নভেম্বর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্মীরা মাদকসহ তারিফ নামের একজনকে আটক করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ক্যাম্পাসের মাদকচক্রের ৮ জনের নাম প্রকাশ করেন, যাদের মধ্যে ৪ জন কর্মচারী, ২ জন বস্তির ভাড়াটিয়া ও ২ জন বহিরাগত। এ ছাড়া গত ৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকসহ ২৮ জনকে আটক করা হয়েছে। যার মধ্যে বেশির ভাগই ক্যাম্পাসের অবৈধ ভাড়াটিয়া।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘অবৈধ এসব বস্তির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা কমে গেছে। মাদকদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর বিপদগামী হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। অন্যদিকে এসব ভাড়াটিয়া অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস ব্যবহারের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই এক সপ্তাহের মধ্যে তারা এই সমস্যার সমাধান চান।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আরফান আলী বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট বাড়িগুলোতে গিয়ে বহিরাগতদের ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশনা দিয়ে এসেছি। এখন অ্যাকশনে যাব। নির্দেশ অমান্যকারীদের বাড়ির বরাদ্দ বাতিল করা হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘সাবেক প্রক্টর বর্তমানে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ফলে নতুন প্রক্টর পদায়নসহ তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’