
উনিশ বছর পেরিয়ে ২০ বছরে আজকের আধুনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। তবে এ দুই দশকে এখনো অনাবাসিক তকমা মুছতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। সময়ে-অসময়ে শিক্ষার্থীদের বহুবিধ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০২০ সালে শুধু ছাত্রীদের জন্য একটি আবাসস্থল ছাড়া আর কোনো আবাসন নেই এ ক্যাম্পাসে।
যদিও ২০১৬ সালে হলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা তুমুল আন্দোলন করলে ২০১৮ সালে তৎকালীন সরকারপ্রধান কেরানীগঞ্জে ২০০ একর জায়গায় একটি আধুনিক ও মানসম্মত ক্যাম্পাস তৈরি করার ঘোষণা দেয়। শিক্ষার্থীরা তখন রাজপথের আন্দোলন গুটিয়ে নিয়ে পড়ার টেবিলে ফিরে যায়।
শিক্ষার্থীদের আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে ২০১৮-২০২৪ এ ছয় বছর পার হলেও এখনো কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুফল হিসেবে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের অগ্রগতি নেই। বারবার কেন শিক্ষার্থীদের একটি মৌলিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই যুগে বহু প্রশাসনের রদবদল হয়েছে। ধারাবাহিক পরিবর্তনে এক উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ থেকে শুরু করে প্রতিটি চেয়ারে একজনের বদলে আরেকজন আসছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই রয়ে গেল। আবাসন সংকট নিয়ে যেখানে পুরান ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে সর্বত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় এখানকার অধ্যায়নরত প্রতিটি শিক্ষার্থীকে। তারপরও কেন এত উদাসীন আচরণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমন প্রশ্নও রেখেছেন একাধিক শিক্ষার্থী।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ইস্যুতে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এসে পুরো প্রকল্প সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তরসহ রাজপথে তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত গত ১১ নভেম্বর তিন দফার আন্দোলন পাঁচ দফায় গিয়ে সচিবালয়ে ঘেরাও এর মতো কর্মসূচিতে গিয়ে ঠেকে। তারপরও যখন কোনো সুরাহা হয়নি এবার আবারও আমরণ অনশন আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
আজ সকাল ৯টা থেকে দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত অনশনের ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
ধারাবাহিক এসব আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সম্মুখ সারির শিক্ষার্থীদের কয়েকজনের অভিমত তুলে ধরা হয়েছে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্প এবং আবাসন সংকটের বিষয়ে।
দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ধীরগতি ও আবাসন সংকটের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ যোদ্ধা ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ইস্যুতে অনশন কর্মসূচির ঘোষক আন্দোলনকারীদের অন্যতম ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফেরদৌস শেখ বলেন, ‘এভাবে আসলে আমাদের স্বপ্ন নিয়ে আর কেউ খেলা করতে পারে না। জুলাই বিপ্লবে একবার জীবন দিতে দিতে শেষ মুহূর্তে বেঁচে ফিরলেও আবার দরকার হলে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েও দাবি আদায় করব ইনশাআল্লাহ। আমরা নতুন বাংলাদেশে কোনো বৈষম্য দেখতে চাই না। রাজপথে আর কত শত বুলেট কিংবা মিছিলের ঝান্ডা উড়ালে হাজারো জবিয়ানের লুণ্ঠিত মৌলিক স্বপ্ন পূরণ হবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘পুরান ঢাকায় মেসে থেকে অনেক শিক্ষার্থী ঠিকমতো পড়াশোনা তো দূর খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করতে পারে না। যেখানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে টিউশনি করে চলতে হয় জীবন চালিয়ে নেওয়ার জন্য সেখানে আবাসন সংকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি বুঝে না। এবার আমরা আর খালি হাতে ফিরতে চাই না। এবার হয় মরব নতুবা দাবি আদায় করে ফিরব।’
দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও আবাসন সংকট নিয়ে আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আরেক শিক্ষার্থী ফয়সাল মুরাদ বলেন, ‘অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার ছিলাম এবারই আছি। যেহেতু সেনাবাহিনীর হাতে কাজ হস্তান্তরে ধীরগতি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছে এজন্য আমি এবং ফেরদৌস দুজনে আগামী রবিবার আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে আমরা অবাক হয়ে গেলাম আমাদের এ অনশনের খবর শুনে একের পর এক শিক্ষার্থীও সংহতি প্রকাশ করে আমরণ অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এগুলো দেখার পরও কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কষ্টগুলো দেখে না, বুঝে না। তবে এবার আর নয়। হয়তো আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সফল হব নতুবা নিজেকে বিলিয়ে দেব জুলাই বিপ্লবের শহিদের মতো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থী ও দ্বিতীয় ক্যাম্পাস আন্দোলনের সংগঠক কে এম এম রাকিব বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা করছে আমাদের সঙ্গে তা একেবারে অযৌক্তিক এবং অন্যায়। আমরা একটু যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমেই এর সুরাহা করতে চেয়েছি কিন্তু তারপরও দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে আমাদের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জগন্নাথের একজন শিক্ষার্থী জানেন তার প্রতিনিয়ত কতটা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে হয়। আমরা চাই অনতিবিলম্বে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস প্রকল্পটি সেনাবাহিনী হাতে হস্তান্তর করে হাজারো জবিয়ানের অস্থায়ী আবাসন সমস্যা দ্রুত সমাধান করুক।’
নবীন শিক্ষার্থীদের আক্ষেপের কথা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের মায়িশা ফাহমিদা ইসলাম বলেন, ‘হলবিহীন একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর কী কষ্ট সেটা মনে হয় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জানে না। এমনকি তারা কখনো সেটা বুঝতেও চায় না। পুরান ঢাকার মতো এমন পরিবেশে আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি কখন কোন বিপদ এসে হানা দেয়। আর একেবারে নবীন হলে তো কোনো কথা নেই। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের।’
/আবরার জাহিন