
একটু উষ্ণতার খোঁজে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে শীতপ্রধান অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পাখি আমাদের দেশে ছুটে আসে। এদের বলা হয় অতিথি পাখি। কিন্তু এ পাখিদের অতিথির সমাদরে থাকা হয় না। এক শ্রেণির পাখি শিকারিদের শিকার হচ্ছে তারা।
তার ব্যতিক্রম নয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। ছোট ছোট টিলা আর সবুজ গাছ-গাছালিতে ঘেরা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই ক্যাম্পাসে অতিথি পাখিরা শিকারিদের কারণে বিপন্ন হচ্ছে। ফলে বছর বছর কমছে এখানে অতিথি পাখি আসার সংখ্যা।
প্রতিবছরই শীতকালে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের ঘন ঝোপ-জলাশয়ে বসতি গাড়ে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখি। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির কোলাহলে এক অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে। শীত মৌসুমে অতিথি পাখির জন্য এক নিরাপদ আস্তানা হয়ে উঠে সিলেট অঞ্চল। কিন্তু স্থানীয় পাখি শিকারিদের আনাগোনায় সেই নিরাপদ আস্তানাটাই এখন রূপ নিচ্ছে পাখিদের মরণফাঁদ হিসেবে। স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতকারী প্রতিনিয়তই পাখি শিকার করার নানা পাঁয়তারা করে। ফলে কমছে অতিথি পাখির সংখ্যা।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) এরকমই কিছু পাখি শিকারিকে হাতেনাতে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক করিমা বেগম। চোরা শিকারিরা পালিয়ে গেলেও টোপ হিসেবে ব্যবহার করা একটি পাখি এবং পাখি ধরার জাল জব্দ করেন তিনি।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেদিন হঠাৎই তিনি দেখতে পান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের পাশেই কিছু লোক জাল দিয়ে পাখি শিকার করছে। সে সময় তিনি এবং তার স্বামী বাধা দিতে গেলে চোরা শিকারিরা তাদের হাতের দা দেখিয়ে হুমকি দেয় এবং পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের পরে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেয়। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন করিমা বেগম ও তার পরিবার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের অধিকাংশ স্থানেই নেই কাঁটাতার। কোথাও আবার দেয়ালের দুই পাশে মাটি ফেলে উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে যাতায়াতের রাস্তা। আবার তৈরি করা হয়েছে সুড়ঙ্গ। সীমানা প্রাচীর মেরামতেও প্রশাসনের নেই কোনো পদক্ষেপ। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের দুটি প্রধান ফটক থাকলেও তার পাশাপাশি সীমানা প্রাচীরজুড়ে আছে চারটি পকেট গেট। চারটি পকেট গেটের মধ্যে দুইটিতে নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও বাকি দুইতে নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা। এসব রাস্তাকে চোরাই রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে খুব সহজেই যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে পাখি শিকারের মতো যেকোনো অপকর্ম করতে পারে।
এ ব্যাপারে ক্যাম্পাসভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন ‘গ্রিন এক্সপ্লোর সোসাইটি’র সভাপতি মো. রমজান হোসেন রনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চোরা শিকারিদের পাখি শিকারের বিষয়টি জেনেছি এবং এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি পাখিসহ সার্বিক নিরাপত্তার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে আকাশমণি বা ইউক্যালিপটাস গাছের মতো ক্ষতিকর গাছগুলো কেটে, এর পরিবর্তে পরিবেশের জন্য উপকারী গাছপালা রোপণের অনুরোধ করব। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় আবার যেন পাখিদের জন্য একটি অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর কাছে পাখিদের নিরাপত্তা দিতে আহ্বান জানিয়ে শাবিপ্রবির ভূসম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, ‘প্রতিবছর প্রচুর অতিথি পাখি আমাদের ক্যাম্পাসে আসে। এই পাখি খেতের পোকামাকড় খেয়ে ফসলকে সুরক্ষিত রাখে। এই পাখি সম্পদ যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের কৃষি সম্পদও শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমানে চোরা শিকারিদের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’
বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশের ভারসাম্যের কথা চিন্তা না করে অপরিকল্পিত বনায়ন করা হয়েছে জানিয়ে আবুল হাসনাত আরও বলেন, ‘বনায়নে অধিকাংশই ছিল আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছ। এসব গাছ পরিবেশ ও মানুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।
পাশাপাশি আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, এসব গাছে পাখিদের জন্য খাবার বা আশ্রয়ের কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকে না। তাই সবাই মিলে উদ্যোগ নিয়ে যদি এই গাছগুলোর পরিবর্তে পরিবেশের জন্য উপকারী গাছ লাগাই, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারব।’
শাবিপ্রবির প্রক্টর অধ্যাপক মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জায়গায় সীমানা প্রাচীরে তারকাঁটা নেই বা সুড়ঙ্গ রয়েছে, আমরা ইতোমধ্যে সেগুলো মেরামতের ব্যবস্থা নিয়েছি। পাশাপাশি যেসব জায়গায় সীমানা প্রাচীর নেই, সেসব স্থানে আমরা তারকাঁটা দেওয়ার ব্যবস্থা করব।’
নিরাপদে অতিথি পাখির বসবাসে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রক্টর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেট গেটগুলো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি এবং আগে যেগুলোতে নিরাপত্তাকর্মী ছিল না, সেই পকেট গেটে এখন থেকে সারাদিন তারা থাকবেন।’