‘ও পলাশ, ও শিমুল/ কেন এ মন মোর রাঙালে/ জানি না, জানি না/ আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে…’ আগুনরাঙা বসন্ত এলেই মনে পড়ে লতা মঙ্গেশকরের এই কালজয়ী গান। বাংলার বসন্তের সাথে পলাশের উপস্থিতি সহজাত। আর পলাশ মানেই রক্তরঙা আভায় আলোর বিচ্ছুরণে পর্ণমোচী বনের নবনৃত্যকলা।
আচমকা পলাশ ফুল দেখে মনে হতে পারে থোকা থোকা আগুনের শিখা। পলাশ যেন শীতের রিক্ততা কাটাতে বসন্ত-প্রকৃতির মন রাঙানোর দায় নিয়েছে। মাটির পরশে বেজে ওঠে মিষ্টি হারমোনির মর্মর ধ্বনি। আগুনরাঙা ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো শিক্ষাঙ্গন। ফুলের পাপড়ি ঘাসের জমিনে পড়ে যেন লাল কার্পেটে রূপ নিয়েছে। পলাশদামে মুখ ডুবিয়ে মেটে শালিকের সে কি আনন্দ! পত্রহীন ডালের ফাঁক গলে নীলাকাশে শোভিত রঙের খেলা। এ যেন বসন্তের আগমনী বার্তা। শুধু বার্তা নয়, গাছে গাছে ফোটা নতুন কুঁড়ি আর নানা রঙের বাহারি ফুল জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে।
বলছিলাম শীতের আড়মোড়া ভেঙে রুক্ষতা বিদায় করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বসন্তের প্রাণ আগুনরাঙা পলাশের কথা। এই রক্তরাঙা পলাশের রক্তিম রঙে পুরো ক্যাম্পাস রঙিন হয়ে উঠছে। পলাশদামে মুখ ডুবিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে পাখির ঝাঁক। ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে নবরূপে। গাছে গাছে পাখির কলকাকলি। কুহু কুহু ধ্বনিতে শোনা যায় কোকিলের কুহুতান। সব মিলিয়ে এ যেন এক প্রকৃতির নবপ্রাণ।
প্রকৃতি আমাদের যাপিত জীবনের নিত্যসঙ্গী। মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতির মতো পরিবেশ-প্রকৃতিও বদলায়। প্রকৃতির এই অদলবদলের খেলায় বিপুল ঐশ্বর্যধারী ঋতুরাজ বসন্তের হাওয়ায় যখন মুখরিত চারপাশ, তখন প্রকৃতির সাথে বাঙালিও বসন্ত-প্রেমের স্বাদ নিতে শুরু করে। দখিনা-বাতাসে নেওয়া শুরু করে নিঃশ্বাস। বনফুলের পল্লবে পাগলের ন্যায় উত্তরীয় উড়িয়ে আপন মনে গায় গান। প্রেমিকের হৃদয়ে লাগে প্রেমের দোলা।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমির নগরীখ্যাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গন একেক ঋতুতে পায় একেক রূপ। শীতের সময় এই হিম নগরী মুগ্ধ থাকে অতিথি পাখির কলতানে, বসন্তে ফুলের সৌরভে মুখরিত করে চারপাশ আর পাখির কলকাকলিতে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে স্তব্ধ রাখে কোলাহল। গ্রীষ্মে বাহারি ফলের ছড়াছড়িতে আকৃষ্ট করে যে কাউকে। সাংস্কৃতিক উৎসবের সেরা বিদ্যাপীঠ হিসেবে সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত জাহাঙ্গীরনগরে যখন বসন্তের আগমন ঘটে, তখন ক্যাম্পাস যেন সব ছাড়িয়ে তার নিজস্ব সত্তাটিকেই ধারণ করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বসন্তের মৌসুমে পলাশ ফুলের গাছগুলো এক চমৎকার দৃশ্য উপস্থাপন করে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশে সারি সারি পলাশগাছ ফুলে পূর্ণ হয়ে উঠেছে, আর তাদের উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল যেন পুরো পরিবেশকে প্রাণবন্ত করে তোলে। পর্ণমোচী প্রতিটি গাছে বসন্তের হাওয়ায় পলাশ এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য অনুভূতির নাম এবং এর সুমিষ্টতা হয়তো পাখিদের বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টির কারণ, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শাখা-প্রশাখা ও আঁকাবাঁকা কাণ্ডের গাছটির টকটকে লাল ছাড়াও জাহাঙ্গীরনগরে হলুদ ও লালচে রঙের ফুল দেখা যায়। এই সময়টাতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী এবং দর্শনার্থীরা যেন ফুলের মাঝে হারিয়ে যায়, প্রকৃতির সাথে একাত্ম হতে চায়।
শহুরে জীবনের কোলাহলে ঋতুরাজ কিংবা গ্রীষ্ম তাপমাত্রার অসহ্যতা ছাড়া ঠিক আলাদাভাবে হয়তো প্রভাব ফেলে না। হয়তো গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম জানান দেয় তার উপস্থিতি। ঋতুরাজ বসন্তের হয়তো সে সুযোগ নেই। কিন্তু ঢাকার অদূরে অবস্থিত এক নৈসর্গিক শিক্ষাঙ্গন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বসন্ত আসে মায়া ছড়িয়ে। প্রকৃতির শোভা ছড়িয়ে ভালোবাসার গান গেয়ে গেয়ে। মনের আনন্দে পাখিরা গান গাইতে শুরু করে। বসন্ত মানুষের হৃদয়ে তোলে ঢেউয়ের তাল। সে তাল পূর্ণতা পায় সুর শ্বাশতে। রবীন্দ্র-নজরুলেও এ বসন্ত ধরা দেয় কখনো বিরহী, কখনো আনন্দ, কখনো সৃষ্টি, কখনো প্রকৃতির অনবদ্য গানে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তকে তুলে এনেছেন গানে, ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়/ ফুল ফুটেছে বনে বনে/ শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায় ফাল্গুনী মোর মন বনে।’ আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যে বসন্তকে তুলে ধরেছেন, ‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়।’ এখানকার শিক্ষার্থীদের অবচেতন মনেও বসন্তের এই প্রভাব পড়ে। বসন্তের এই দিনে পর্ণমোচী বনের উদাসী বাতাসে শুকনো পাতার নূপুরের নিক্বণ আর দূর থেকে ভেসে আসা বসন্তদূত কোকিলের কুহুতানের ধ্বনিতে প্রেমিকযুগলের হৃদয় আকুল করে হৃদয়মন্দিরে গেয়ে ওঠে, ‘আজি, খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো/ আজি, ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো/ এই সংগীত-মুখরিত গগনে/ তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।’
কেউ কেউ নিঃসঙ্গতায় হয়তো বলে ওঠে, ‘দূরে, গগনে কাহার পথ চাহিয়া/ আজি, ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।’
আমানউল্লাহ/তাওফিক