
মায়ের জন্য ঈদের আগে অবশ্যই একটা শাড়ি কিনতে হবে। এদিক-ওদিক ঘুরছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান। এত এত শাড়ির মধ্যে কোন ধরনের শাড়ি নেবেন সেটি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। একটু সময় নিয়ে জানালেন- টিউশনির টাকা দিয়ে মাকে কিছু একটা কিনে দিতে চাচ্ছেন কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
আতিকুরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সামনে ঠিক ইফতারের পর। চারদিকে অনেক মানুষের আনাগোনা। এলইডি হ্যালোজেন লাইটের আলোয় চারদিকটা বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি টেবিল পেতে বসে আছে কিছু মানুষ। মিটিমিটি আলো জ্বলছে দোকানগুলোতে। টেবিল নিয়ে ছোট পরিসরে কেউ বিক্রি করছেন শাড়ি, পাঞ্জাবি, প্যান্ট, টি-শার্ট আবার কেউবা খেজুর, মাঠা থেকে শুরু করে হরেক রকমের খাবার। রোজার ঈদের আগের এই সময় ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়াখ্যাত জায়গাটি এমন জমজমাট হতে কখনোই দেখা যায় না। বস্তুত ক্যাম্পাসে এভাবে দোকান বসাতে দিতে চায় না কর্তৃপক্ষ। এখন অবশ্য কোনো বাধা নেই। হয়তো বাধা দিলে কেউ মানতও না। মজার বিষয় হলো- এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতার প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী। কর্তৃপক্ষের চুপ থাকার হয়তো এটাই কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও চাকরি করার গৎবাঁধা ধারণা থেকে বের হয়ে বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখে কিছু শিক্ষার্থী। ছোট ছোট টেবিল নিয়ে এই হরেক রকমের জিনিসপত্র বিক্রি করাটা হয়তো তাদের সেই স্বপ্নের অংশ। অবশ্য বিক্রেতার কেউ কেউ শুধু আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কথা মাথায় রেখে এই সময়কে ব্যবসার জন্য বেছে নিয়েছেন।'
মায়ের জন্য শাড়ি খুঁজতে থাকা আতিকুরকে সাহায্য করার জন্য তাকে নিয়ে একটি শাড়ির দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট্ট একটা টেবিল নিয়ে বসা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলেন কোন ধরনের শাড়ি নিতে চাই আমরা। সুতির শাড়ি নেবেন বলে জানান আতিকুর। কয়েকটা শাড়ি দেখেই একটা নিয়ে ফেললেন তিনি। বেশ খুশি মনে হলো আতিকুরকে। উদ্যোক্তা ফারজানাও খুশি হলেন। ব্যবসা নিয়ে অনেক সময় কথা বললাম ফারজানার সঙ্গে। তার ব্যবসা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সব সময় স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। আমার বাড়ি যেহেতু সিরাজগঞ্জ তাই শাড়ি নিয়ে কাজ করাটা আমার জন্য কিছুটা সহজ হবে ভেবে আর অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করিনি। ঈদের আগের এই সময় যেহেতু আমাদের প্রতিষ্ঠানের আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে বাড়ি চলে যায়, তাই অনেকেই গ্রামে থাকা মা, বাবা, বা বোনের জন্য কিছু কেনাকাটা করে। অনেকেই বান্ধবীকে শাড়ি উপহার দেয়। সবমিলিয়ে এই সময় বিক্রি অনেক বেশি হয়। আমাদের স্বপ্নের দিকেও এগিয়ে যেতে যেটা সাহায্য করে। সঙ্গে কিছু আয়ও হয়।’
ফারজানার সঙ্গে কথা শেষ করে বেশ ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম রাস্তার পশ্চিম পাশে বিজয় একাত্তর হলের গেটের কাছে। শিক্ষার্থী আবদুর রহিম চামড়ার জুতাসহ এক্সপোর্টের প্যান্ট-শার্ট বিক্রি করছেন। বেশ ব্যস্ত থাকায় খানিকটা সময় অপেক্ষা শেষে কথা হলো তার সঙ্গে। ব্যবসা নিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে তার স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি একটা ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে চান। চামড়ার জুতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। হেমায়েতপুরের জুতার কারখানা থেকে সবচেয়ে ভালো মানের পণ্যগুলো অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসেন বলে জানান আমাদের। তিনি হাসিমুখে একটা তথ্য জানালেন। কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া উদ্যোক্তা মেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে আসেন। স্যারের স্ত্রী স্যারের জন্য আব্দুর রহিমের স্টল থেকে একটা বুট জুতা পছন্দ করেন। পরে নিজে স্যারের বাসভবনে গিয়ে সেই জুতা জোড়া দিয়ে আসেন আব্দুর রহিম। কথাগুলো জানানোর সময় তিনি বেশ গর্ব অনুভব করলেন বোঝা গেল। গর্ব করবেই বা না কেন? স্বয়ং ভিসি স্যার তার দোকানের জুতা ব্যবহার করছেন।
আব্দুর রহিমের ফেসবুকে একটা পেজও আছে। সেখান থেকে মোটামুটি সাড়াও পান। তবে আবাসিক হলগুলোর শিক্ষার্থীরা তার থেকে নিয়মিত পণ্য নিচ্ছেন। ব্যবসা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সব সময় কম দামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জিনিস আনার চেষ্টা করি। পণ্যের কোয়ালিটি নিয়ে আমি ভীষণ সচেতন। যেহেতু এটা নিয়ে আমি স্বপ্ন বুনছি।’
বেশ পরিশ্রমী আর দৃঢ়চেতা মনে হলো আব্দুর রহিমকে। হয়তো ভবিষ্যতে কোনো একদিন দেশের বড় একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।
এতক্ষণে ঠাণ্ডা কিছু খেতে ইচ্ছা হলো আমার। একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম জসিম উদ্দিন হল মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার দিকে মাঠা বিক্রি করছেন সাজিদ নামের এক শিক্ষার্থী। ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যায় এই মাঠা। দেখতে যেমন সুন্দর খেতেও বেশ সুস্বাদু এই মাঠা নিয়ে কথা হলো সাজিদের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চাইলাম, মাঠা নিয়ে ব্যবসা করার চিন্তা মাথায় এল কীভাবে। সাজিদ বললেন, ‘রমজান মাসে রোজা ছেড়ে অনেকেই ঠাণ্ডা এবং পুষ্টিকর কিছু খেতে চায়। মূলত চাহিদার কথা চিন্তা করেই এই ব্যবসা শুরু করেছি।’ মাঠা কোথা থেকে আনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এই মাঠা সরাসরি খামারি থেকে সংগ্রহ করি। তাই এটা ভেজাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
মাঠা খাওয়ার পর আমারও মনে হলো- দিনের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু একটা জিনিস খেলাম। কোনোভাবেই এটা ভেজাল হওয়া সম্ভব না। আশপাশে আরও দোকান ছিল যেমন- খেজুর, কসমেটিকস, সুগন্ধি ইত্যাদি। সময় স্বল্পতার কারণে সব দোকানে আর যাওয়া হলো না। অবশেষে বাসায় ফেরার জন্য মনস্থির করলাম। পাঞ্জাবি সাজানো একটা টেবিল চোখে পড়ল। চোখ আটকে গেল বোটল গ্রিন রঙের একটা পাঞ্জাবিতে। দামও তুলনামূলক কম। ভাবলাম- ঈদের জন্য পাঞ্জাবিটা নিলে মন্দ হয় না।
/রিয়াজ