
বাংলাদেশের কৃষিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে যাচ্ছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) এক গবেষণা। বাজারে প্রচলিত ইউরিয়ার পরিবর্তে উদ্ভাবিত হয়েছে ন্যানো ইউরিয়া, যা প্রচলিত সারের তুলনায় ৮২ শতাংশ পর্যন্ত খরচ সাশ্রয়ী। পরিবেশবান্ধব এই প্রযুক্তি কৃষির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও আনবে টেকসই পরিবর্তন।
যুগান্তকারী এই ন্যানো ইউরিয়া উদ্ভাবন করেছেন যবিপ্রবির কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং ল্যাবরেটরি অব ন্যানো বায়ো অ্যান্ড অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং (NAME Lab)-এর প্রধান গবেষক ড. জাভেদ হোসেন খান। দীর্ঘ সাত বছরের গবেষণায় তিনি এই স্প্রে সারটি উদ্ভাবন করেন, যা সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জৈব সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কুলা বায়ো (Kulabio)-এর সঙ্গে এক যৌথ চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পেয়েছে।
ন্যানো ইউরিয়া হলো অতি সূক্ষ্ম কণায় প্রস্তুত এক ধরনের ইউরিয়া সার, যা স্প্রে করে সরাসরি গাছের পাতায় প্রয়োগ করা হয়। প্রচলিত সারের তুলনায় এতে অণুর আকার অনেক ক্ষুদ্র। ফলে গাছ তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে শোষণ করতে পারে। এতে অপচয় হয় না। আবার মাটির উর্বরতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
ন্যানো ইউরিয়ার উদ্ভাবক ও গবেষক ড. জাভেদ বলেন, ‘আমরা এমন এক ন্যানো সার উদ্ভাবন করেছি, যা সাধারণ ৪২০০ টাকার ইউরিয়ার জায়গায় মাত্র ২৩০ টাকায় এক বিঘা জমিতে প্রয়োগ করা সম্ভব।’
অর্থাৎ, এতে খরচ সাশ্রয় হবে প্রায় ৮২ শতাংশ। ন্যানো ইউরিয়ার কার্যকারিতা ইতোমধ্যে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কৃষকরা এতে ফলন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ব্যয় কমার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছেন।
২৩ এপ্রিল ২০২৫, যবিপ্রবির সংশ্লিষ্ট ল্যাব এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি কুলা বায়োর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কুলা বায়োর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. ফ্রেডেরিক কেন্ডিরগি এবং যবিপ্রবির পক্ষে ড. জাভেদ হোসেন খান।
চুক্তি অনুযায়ী, কুলা বায়ো যবিপ্রবির উদ্ভাবিত ন্যানো সার প্রযুক্তি গ্রহণ করবে এবং নিজেদের জৈব সার প্রযুক্তি NAME Lab-এর সঙ্গে ভাগ করবে। পরবর্তী পাঁচ বছর এই দুই প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে গবেষণা ও উৎপাদন কার্যক্রমে অংশ নেবে।
এ বিষয়ে ড. জাভেদ বলেন, ‘আমি কুলা বায়োর বোস্টন কারখানা ঘুরে দেখেছি এবং তাদের প্রেসিডেন্ট ড. হ্যারিসন ইউনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তারা আমাদের প্রযুক্তিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং খুব শিগগির আমাদের ল্যাব পরিদর্শনে আসবেন।’
বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ টন ইউরিয়া সার ব্যবহার করে, যার প্রায় ৮০% আমদানিনির্ভর। ২০২৪ অর্থবছরে ইউরিয়া আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৭ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ন্যানো ইউরিয়া প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করতে পারলে এই ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসবে। একই সঙ্গে পরিবেশ ও মাটির ওপর বিরূপ প্রভাব হ্রাস পাবে।
যবিপ্রবির এক অধ্যাপকের একাগ্র প্রচেষ্টায় তৈরি হওয়া এই প্রযুক্তি শুধু গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ নয়, তা এখন ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের প্রতিষ্ঠান যখন বাংলাদেশের প্রযুক্তির পাশে দাঁড়ায়, তখন সেটি শুধুই গর্বের বিষয় নয়— বরং তা এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
ন্যানো ইউরিয়া হতে পারে বাংলাদেশের কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের অসাধারণ নিয়ামক, যা একদিকে উৎপাদন খরচ কমাবে, অন্যদিকে নিশ্চিত করবে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ। কৃষি গবেষণায় এটি একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে বলে সবাই আশাবাদী।
/রিয়াজ