চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর নিয়োগকর্তারা হাজার হাজার প্রার্থীর আবেদন গ্রহণ করেন। কিন্তু নিয়োগ দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েন প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন প্রার্থীকে খুঁজে পেতে। উপযুক্ত সার্টিফিকেট থাকলেও স্কিল বা দক্ষতা না থাকায় চাকরি দেওয়া সম্ভব হয় না। সময় দ্রুত বদলাচ্ছে, সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে নিয়োগকর্তাদের দক্ষতার প্রয়োজনীয়তাও বদলে যাচ্ছে।
প্রার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষার পরিপূরক দক্ষতার বিস্তৃত পরিসরসহ লোকবলের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক হওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা ও ক্ষমতা থাকতে হবে। কারণ নিয়োগকর্তার চাহিদার অনেকটাই দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রায়শই চাকরির বাজারের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ব্যবহারিক দক্ষতার পরিবর্তে তাত্ত্বিক জ্ঞানের ওপর বেশি জোর দিয়ে আসছে। অথচ নিয়োগকর্তারা প্রাসঙ্গিক ব্যবহারিক বিভিন্ন দক্ষতার মধ্যে সফট স্কিল অর্থাৎ ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তানির্ভর দক্ষতাকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সফট স্কিল বা কোমল দক্ষতা হলো আন্তঃব্যক্তিক, সামাজিক এবং যোগাযোগের ক্ষমতা যা মানুষকে কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে এবং অন্যদের সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম করে। এগুলো প্রায়শই অস্পষ্ট এবং পরিমাপ করা কঠিন, তবে ব্যক্তিগত এবং পেশা উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক থেকে শুরু করে পেশাগত জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফট স্কিল একজনের সামগ্রিক সাফল্যকে প্রভাবিত করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সফট স্কিল ইংরেজি শব্দ হলেও চাকরিপ্রার্থী বা নিয়োগকর্তারা এটাকে বাংলা ভাষার মতো ব্যবহার করেন। কোমল দক্ষতার চেয়ে শব্দটা সফট স্কিল বলেই বেশি পরিচিত। সফট স্কিলের মর্যাদা দৃশ্যত বোঝা না গেলেও এই স্কিল ক্যারিয়ার গড়তে যেমন সহায়তা করে তেমনি এর অভাবে সহজেই ক্যারিয়ার ভেঙে যায়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু সফট স্কিল সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
কার্যকর নেটওয়ার্কিং বা যোগাযোগ
ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং দ্বন্দ্ব বা বিরোধ মীমাংসার জন্য কার্যকর যোগাযোগ অপরিহার্য। এর মাধ্যমেই মৌখিক, লিখিত ও শারীরিক ভাষার ধারণাগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায় এবং অন্যরাও সক্রিয়ভাবে শোনার আগ্রহ প্রকাশ করে। ধরুন, আপনি একজন বিক্রয় প্রতিনিধি। আপনার প্রোডাক্ট সমাজের তথাকথিত নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। আপনি পড়ালেখা করেছেন নামিদামি প্রতিষ্ঠান থেকে, কিন্তু আপনি জানেন না একজন স্বল্প শিক্ষিত দোকানদারের কাছে কীভাবে প্রোডাক্ট বিক্রি করতে হয়। তার সঙ্গে আপনি ইংরেজিতে কথা বললে বা স্টাইল করে কথা বললে তিনি আপনাকে হয়তো সাদরে গ্রহণ নাও করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনাকে মাথায় নিতে হবে আপনি একজন দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছেন। পক্ষান্তরে, আপনি ইংরেজিতে দুর্বল। কিন্তু আপনার কাজ করতে হবে এমন জায়গায় যেখানে শুধু ইংরেজি নয় আপনাকে থাকতে হবে পরিপাটি। অর্থাৎ এর অর্থ হলো সূক্ষ্মভাবে একটি ব্যবস্থাপনা বা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে।
সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা
আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রায়ই টিমওয়ার্ক বা দলগত কাজের প্রয়োজন। সহযোগিতা এবং অভিযোজন যোগ্যতার মতো দক্ষ ব্যক্তিরা বিভিন্ন দলে কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম। টিমওয়ার্ক হলো একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বা একটি কার্যকর এবং দক্ষ উপায়ে একটি কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য একটি দলের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। এর জন্য প্রয়োজন দক্ষতা, জ্ঞান ও প্রচেষ্টার সমন্বয়। টিমওয়ার্ক বা দলগত কাজে দলের কেউ অপেক্ষাকৃত দুর্বল থাকলেও অন্যরা মিলে ঠিকই সার্বিক সাফল্য বয়ে আনে।
উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির যারা সেলসে কাজ করেন অর্থাৎ কোম্পানির ওষুধ বিক্রি করেন তাদের ফার্স্ট লাইন ম্যানেজার বা প্রথম ধাপের দলনেতাকে সাধারণত এরিয়া ম্যানেজার বলে এবং এই এরিয়া ম্যানেজারের ছয় থেকে সাতজনের টিম থাকে। টিমের দুই-তিনজন প্রতিনিয়তই নতুন সদস্য থাকে। দুই-তিনজন নতুন সদস্য থাকলেও অনেকে দলের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় না, কারণ তাদের সহযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে নতুন সদস্য অর্থাৎ দুর্বল সদস্যরা সর্বোচ্চ অর্জনে অনুপ্রাণিত হয়। আর যেখানে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক দুর্বল থাকে সেখানে তারা ব্যর্থ হয়।
ইতিবাচক নেতৃত্ব
চাকরিতে যোগদানের প্রথম দিন থেকেই আপনার নেতৃত্বকে বিকাশ করতে হবে। নিয়োগকারীরা অবশ্যই যাচাই করেন যে আপনি ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দান করতে পারবেন কি না। যদি আপনি নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তৈরি করতে না পারেন, তাহলে আপনি কোনো দল চালাতে পারবেন না। কোনো প্রতিষ্ঠানের অগ্রসরের অন্যতম উপকরণ হলো নির্দেশনা। শ্রমিক, কর্মচারী এবং অর্থ সব থাকলেও দরকার সঠিক নির্দেশনা। এই নির্দেশনার জন্য প্রয়োজন উন্নত নেতৃত্ব। স্থান-কালভেদে নেতৃত্বের ধরন বা গুণাবলি বদলালেও ইতিবাচক নেতৃত্ব সর্বজন গ্রহণীয়। নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠানে মানবীয় শ্রম ও যান্ত্রিক শক্তিকে নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে ধাবিত করে। নেতৃত্ব কর্মীদের কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে কর্ম সম্পাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে বিধায় নিয়োগকর্তারা নেতৃত্বকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা: বাধা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের একটি নিয়মিত অংশ এবং সেগুলোকে অতিক্রম করা সবসময় সহজ নয়। আপনার পণ্য, পরিষেবা, যোগাযোগ এবং আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতা উন্নত করতে এবং আপনার প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য আপনাকে সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করতে হবে। সেভাবে কাজ করে প্রথমে আপনাকেই উদ্ভাবনী সমাধানগুলো খুঁজে বের করতে হবে।
কোনো সমস্যা উদ্ভব হলে সমস্যার কথা ঊর্ধ্বতনকে অবগত করলে যতটুকু খুশি হন তার বেশি খুশি হন সমস্যার সঙ্গে কিছু সম্ভাব্য সমাধানের কথা জানালে। এখন গতানুগতিক কাজে কেউ তেমন সন্তুষ্ট হয় না। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি অন্যদের থেকে একটু আলাদা। বাক্সের বাইরে চিন্তা করে নিজেকে শ্রেষ্ঠভাবে উপস্থাপন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সময় ব্যবস্থাপনা
আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো সুসম্পন্ন করতে আপনি কোন কাজে কতক্ষণ সময় বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যয় করবেন তার কার্যকর পরিকল্পনাকেই সময় ব্যবস্থাপনা বলে। জীবনের জন্য সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সুখ-শান্তির অনেকটাই নির্ভর করে সময় ব্যবস্থাপনার ওপর। এককথায় সময়ের কাজ সময়ে করতে পারার মতো দক্ষতার বিকল্প নেই। সময়ের সঙ্গে মানসিক চাপ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আপনি যতই বড় হবেন আপনার সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজের চাপও বাড়বে।
সময় ও কাজের চাপের ব্যবধান কমাতে না পারলে আপনি প্যাশন, ক্যারিয়ার, পরিবার ও সামাজিকতা থেকে আপনি অনেক দূরে সরে যাবেন। তাই সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা জরুরি। সঠিক সময় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন করতে পারলে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় যা সার্বিক সাফল্য লাভের পথকে প্রশস্ত করে।
পরিশেষে, সফট স্কিল শুধু কাম্য নয়; এগুলো আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজের সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। এর মাধ্যমে চাকরিপ্রার্থী থেকে শুরু করে সবাই তাদের পূর্ণ সম্ভাবনাকে উন্মোচন করতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে তাদের পরিবার, সম্প্রদায় এবং সমাজে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখতে পারে।
লেখক: প্লান্ট এইচআর হেড, রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
কলি