প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান, যা ইংরেজিতে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি নামে পরিচিত। এটি জীববিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গতিশীল ও আকর্ষণীয় শাখা। এটি জীবের কোষ এবং অণুর রাসায়নিক গঠন ও কার্যপ্রণালি নিয়ে গবেষণা করে। প্রাণরসায়ন আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি দিক প্রভাবিত করে। এটি কোষ কীভাবে বৃদ্ধি এবং বিভাজন করে, খাদ্য কীভাবে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়, রোগের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে এবং এমনকি আমরা কীভাবে চিন্তা করি ও অনুভব করি তা ব্যাখ্যা করতে পারে। এই বিষয়ে পড়াশোনা এবং কর্মজীবন গড়ে তোলার বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন।
যেখানে পড়ানো হয়
বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ার সুযোগ রয়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে এই বিষয় পড়ানো হয়। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ার সুযোগ রয়েছে।
যা পড়ানো হয়
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ কেবল মৌলিক প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে আরও অনেক আকর্ষণীয় বিষয় পড়ানো হয়, যা জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক অন্বেষণ করে। এর কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো-
ইমিউনোলজি: আমাদের শরীর কীভাবে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে তা শেখায়।
মলিকুলার জেনেটিক্স: জিন কীভাবে কাজ করে এবং জীবকে নিয়ন্ত্রণ করে তা বোঝায়।
মলিকুলার বায়োলজি: জীবের কোষ ও জৈব অণুর গঠন ও কার্যকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি: একটি জীব কীভাবে বৃদ্ধি পায় এবং পরিণত হয় তা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
বায়োইনফরম্যাটিক্স: জৈবিক ডেটা বিশ্লেষণের জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞানের ব্যবহার।
প্রোটিন টেকনোলজি: নতুন বা উন্নত প্রোটিন তৈরি করা, যা রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সহায়তা করে।
প্ল্যান্ট বায়োটেকনোলজি: উদ্ভিদের জিনগত পরিবর্তন করে উন্নত জাত কীভাবে তৈরি করে তা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
খাদ্য ও পুষ্টি: খাদ্যের রাসায়নিক গঠন, পুষ্টিগুণ ও শরীরে এর প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞান দেয়ে।
মেডিসিনাল বায়োকেমিস্ট্রি: ওষুধ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জৈব যৌগ সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
ড্রাগ ডিজাইন: বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে নতুন ও আরও কার্যকর ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া শেখায়।
ন্যানো বায়োটেকনোলজি: জৈব অণু (বায়োমলিকুল) ও ন্যানো প্রযুক্তির সমন্বয় সাধন করে।
স্ট্রাকচারাল বায়োলজি: জীবের বিভিন্ন অংশের ত্রিমাত্রিক গঠন ও কার্যকারিতা সম্পর্কে জ্ঞান দেয়।
সিস্টেমস বায়োলজি: জীবের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জটিল রিলেশনশিপ বোঝায়।
যদিও এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়। জীববিজ্ঞান বিভাগ নিয়মিত নতুন নতুন বিষয় ও গবেষণা ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত করছে।
গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা
বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ
বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ে পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন দেশে অনেক সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে, আমেরিকা, বৃটেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, সাউথ কোরিয়া এবং কানাডা এই বিষয়ে পড়াশোনার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য।
স্কলারশিপের সুযোগ
এই বিষয়ে পড়লে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পাওয়া যায়, যা আপনার পড়াশোনার খরচ বহনে সহায়তা করতে পারে। স্কলারশিপের মধ্যে রয়েছে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ, ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ, মেক্সট স্কলারশিপ, ফুলব্রাইট স্কলারশিপ, DAAD স্কলারশিপ। এ ছাড়া আরও স্কলারশিপ রয়েছে বিভিন্ন দেশের, যা অত্যন্ত সম্মানের ও গৌরবের।
যোগ্যতার শর্তগুলো
স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে, আপনার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো একাডেমিক রেকর্ড এবং পূর্বের গবেষণা অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। আপনার যদি গবেষণা প্রবন্ধগুলো বনেদি জার্নালে প্রকাশিত থাকে তবে এটি আপনার স্কলারশিপ পাওয়ার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে।
চাকরির সুযোগ
বাংলাদেশে প্রাণরসায়ন বা বায়োকেমিস্ট্রি, একটি ক্রমবর্ধমান ক্ষেত্র, যা উজ্জ্বল কর্মজীবনের সুযোগ দেয়। এই বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।
ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রগুলো
গবেষণা: ইমিউনোলজি, বায়োইনফরম্যাটিক্স, বায়োফিজিক্স, বায়োইঞ্জিনিয়ারিং, জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি নিয়ে গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
শিক্ষকতা: বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষতার সুবর্ণ সুযোগ।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল চাকরি: বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি, বায়োটেকনোলজি কোম্পানিতে চাকরির অবারিত সুযোগ রয়েছে।
অন্যান্য: রাসায়নিকশিল্প, খাদ্যশিল্প, ফরেনসিক ল্যাব, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ল্যাব, প্রসাধনশিল্পেও রয়েছে চাকরির সুযোগ।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
বেসরকারি চাকরির মাঝে ব্যাংক, বহুজাতিক কোম্পানি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিসিএস জেনারেল এবং টেকনিক্যাল উভয় ক্যাটাগরিতে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা চাকরি করার সুযোগ পাবেন।
তাছাড়া একজন স্নাতকোত্তর হিসেবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাকরি ও পিএসসির (নন ক্যাডার) চাকরি পাওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে।
বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারীরা সাধারণত বিসিএসআইআর, আইসিডিডিআরবি, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বারডেম, বিসিআইসি, বিএসএমএমইউ(পিজি), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ড্রাগ সুপার, ড্রাগ ইন্সপেক্টর, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শিশু হাসপাতালের অধীন সিএইচআরএফের রিসার্চ অফিসার, বাংলাদেশ পুলিশের ফরেনসিক বিভাগসহ বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তাছাড়া ব্যাংক ও বিমা সংশ্লিষ্ট চাকরির পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক ল্যাব সংশ্লিষ্ট চাকরির অবারিত সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে বায়োকেমিস্ট্রি একটি সমৃদ্ধ এবং বর্ধনশীল ক্ষেত্র যা জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য উজ্জ্বল কর্মজীবনের সুযোগ দেয়। যারা জীববিজ্ঞান, রসায়ন এবং গবেষণার প্রতি আগ্রহী তাদের জন্য এটি একটি সেরা পছন্দ।
অনুলিখন: শাহ বিলিয়া জুলফিকার
কলি