ছাত্রজীবন একজন ব্যক্তির জীবনের ভিত্তি গঠন করে। এই সময়কাল সঠিক পথে পরিচালিত হলে ভবিষ্যতের সফলতা নিশ্চিত করা যায়। ছাত্রজীবনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক অনুসরণ করলে একজন শিক্ষার্থী সঠিক পথে এগিয়ে যাবে। ছাত্রজীবনে কিছু করণীয় ও বর্জনীয় দিক নিয়ে পরামর্শ তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. এস এম রাশিদুল হাসান
সময়ানুবর্তী হতে হবে: আমরা সবাই জানি সময়নিষ্ঠ হওয়া কতটা জরুরি। তারপরও কেন অনেকেই পারে না। খুব সাধারণভাবে যদি মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করি, এক শ্রেণির মানুষ যারা জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বোঝে এবং সে অনুসারে পরিকল্পনা করতে পারে। অপর শ্রেণির মানুষ যারা নিজেদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো ভাবনা নেই, গড্ডালিকা প্রবাহের মতো সময়ের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। নিশ্চিতভাবেই প্রথম শ্রেণির মানুষ অনেক বেশি সময়নিষ্ঠ হবে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষদের থেকে। কারণ তারা শুধু এটা জেনেই বসে থাকে না যে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’, বরং তারা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সময়ের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে জীবনকে পরিচালিত করে। এরাই জীবনে সফলতা লাভ করে।
সময়ানুবর্তিতা একজন শিক্ষার্থীর সফলতার প্রধান চাবিকাঠি। সঠিক সময়ে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া, নির্ধারিত সময়ে পড়াশোনা করা এবং নির্ধারিত সময়ে বিশ্রাম নেওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। আর এক্ষেত্রে দেরি করা, কাজ ফেলে রাখা, নিয়মিত সময়ে না ঘুমানো ইত্যাদি পরিত্যাগ করতে হবে। সময়ের প্রতি উদাসীনতা একজন শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে দেয় এবং তাদের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
ভালো সঙ্গী বাছাই করতে হবে: সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ- ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদি (রহ.) যথার্থই বলেছিলেন। বর্তমান সময়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। আপনার বন্ধু নির্বাচনের ওপর আপনার জীবনের অনেক বড় একটি অংশ নির্ভর করে। ভালো বন্ধু আপনার জীবনকে সুখে সাজিয়ে দেবে। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে আপনি কাদের নির্বাচন করবেন? যারা আপনার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাকি অসামঞ্জস্যপূর্ণ? নিশ্চয়ই সামঞ্জস্যপূর্ণ মানুষদের।
কারণ, এরা আপনাকে সাহায্য করবে আপনাকে সৎ পরামর্শ ও সহায়তার মাধ্যমে। তাই ভালো বন্ধু নির্বাচন করতে হবে, যারা পড়াশোনা এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নে উৎসাহ দেয়। ভালো বন্ধু এবং সহপাঠী পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নে সহায়ক। অন্যদিকে খারাপ সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে হবে, যা বিভ্রান্তি এবং নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। খারাপ সঙ্গর কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে বিমুখ হতে পারে এবং অসৎ কাজের দিকে ঝুঁকতে পারে।
পেশাভিত্তিক শিক্ষা নির্বাচন: অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসএসসি/এইচএসসি পাস করার পর হয় ডিপ্লোমা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদের অনেকেই হতাশ হয়ে শুরু থেকেই পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে। আবার, পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও অনেকে বিপথগামী হয়ে পড়ে।
একটা বিষয় সবার জানা থাকা প্রয়োজন, চাকরির বাজারে দক্ষ মানুষ প্রয়োজন। যে বিষয়েই পড়াশোনা করুন না কেন, নিজেকে সেই বিষয়ের ওপর পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে পারলে ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ার প্রয়োজন নেই। তার অর্থ হলো, পড়াশোনায় যেসব বিষয় দক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক, সে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে পড়তে হবে। যেসব কোর্সে হাতে-কলমে শিক্ষার গুরুত্ব বেশি, সেসব কোর্স শুধু পাস করার জন্য না পড়ে, Skilled হওয়া প্রয়োজন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) ব্যবহার: ভবিষ্যৎ পৃথিবী সফট স্কিলের ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। নিকট অতীত ও বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতির ধারা সেদিককেই নির্দেশ করে। শুধু আইসিটি নয়, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদির ওপর দক্ষতা আপনাকে নিঃসন্দেহে অনেকের থেকে এগিয়ে রাখবে।
মজার বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বা গতানুগতিক শিক্ষার বাইরেও আপনি আইসিটি, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর শিক্ষা লাভ করতে পারবেন। তাই কম্পিউটার, ইন্টারনেট, এবং অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শেখা এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। আর প্রয়োজনীয়তা ছাড়া অতিরিক্ত সময় প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য সময় নষ্ট করা যাবে না। প্রযুক্তির অপব্যবহার শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট করে এবং তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পাঠক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ: খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত কার্যক্রম শিক্ষার্থীর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক। এটি তাদের নেতৃত্বের গুণাবলি এবং সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়তা করে। কেবলমাত্র একাডেমিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা এবং অন্যান্য কার্যক্রমকে উপেক্ষা করলে চলবে না।
অতিরিক্ত বই পড়া: বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে হবে যেমন- সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি। শুধু পাঠ্যবই পড়া এবং অন্যান্য বইকে উপেক্ষা করলে হবে না। কেননা, স্কুল বইয়ের বাইরের বই পড়া শিক্ষার্থীর জ্ঞান বৃদ্ধি করে, ভাষার দক্ষতা উন্নত করে এবং তাদের কল্পনাশক্তি এবং সৃজনশীলতাকে প্রখর করে।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: নিয়মিত ব্যায়াম করা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত ঘুমানো এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করা অতীব জরুরি। অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত স্ট্রেস নেওয়া এবং অপর্যাপ্ত ঘুম বর্জন করতে হবে। কেননা, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্ষেত্রে মনোনিবেশ করতে এবং আরও ফলপ্রসূ হতে সহায়ক। এটি তাদের জীবনে সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসে।
বিশেষ পরামর্শ: ছাত্রজীবনে সঠিক দিকনির্দেশনা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম অনুসরণ করে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করতে পারে। সময়ানুবর্তিতা, ভালো সঙ্গ, পেশাভিত্তিক শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার, অতিরিক্ত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, বই পড়া এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া একজন শিক্ষার্থীকে সফলতা এবং সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে, আমি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো অনুসরণ করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি, যাতে তারা তাদের শিক্ষাজীবন এবং পরবর্তী কর্মজীবনে সফল হতে পারে।
অনুলিখন: শাহ বিলিয়া জুলফিকার
কলি