সময়টা পাল্টেছে। এখন যেকোনো বিষয়ে একাডেমিক পড়াশোনা করলেই হয় না। একই সঙ্গে ধারণা থাকতে হয় বিষয়ভিত্তিক চাকরির বাজারের হালচাল সম্পর্কে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান সময়ের পরিবর্তনশীল বাজারে সমাজবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত বা স্নাতক ডিগ্রিধারীদের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছেই। নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে না থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
সমাজবিজ্ঞান কী
সমাজবিজ্ঞান হলো সমাজ সম্পর্কিত বিজ্ঞান। সামাজিকবিজ্ঞানের যে শাখা সমাজ নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে থাকে তাকেই সমাজবিজ্ঞান বলে। কাল মার্কসকে সমাজবিজ্ঞানের গুরু বলা হয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানের জনক ফরাসি চিন্তাবিদ অগাস্ট কোঁৎ সর্বপ্রথম ১৮৩৯ সালে সমাজবিজ্ঞানের ধারণা দেন। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার পেছনে যে সমাজবিজ্ঞানীর অবদান স্বীকৃত তিনি হলেন, এ কে নাজমুল করিম। এজন্য তাকে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের জনকও বলা হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনেসকোর যৌথ উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলোতেও সমাজবিজ্ঞানের ওপর অধ্যয়ন শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় সমাজবিজ্ঞানের নানা ডালপালা বিস্তৃত হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়
সমাজবিজ্ঞান মূলত পরিবার, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সমাজ, সমাজ কাঠামো, ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমতা, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, দর্শন ও অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে থাকে। বাংলাদেশে সমাজবিজ্ঞানের প্রথাগত ও ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, শান্তি সংঘর্ষ, অপরাধ বিজ্ঞান, পপুলেশন সায়েন্স, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, যোগাযোগ বৈকল্য, প্রিন্টিং ও পাবলিকেশন স্টাডিজ, টেলিভিশন ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জনবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, সামাজিক গবেষণা ও সামাজিক আইন ইত্যাদি।
বিদেশে উচ্চশিক্ষা
সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক তাদের জন্য রয়েছে অবারিত সুযোগ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বহুল প্রায়োগিক গুরুত্বের জন্য উচ্চশিক্ষায় সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোর রয়েছে বিশেষ কদর। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর পর সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপের সুযোগও রয়েছে। এক্ষেত্রে ভালো সিজিপিএ ও আইইএলটিএস স্কোরের পাশাপাশি দু-একটি রিসার্চ পেপার/গবেষণা প্রতিবেদন থাকলে এই সম্ভাবনা বহু গুণে বেড়ে যায়। দেশের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে প্রতিবছরই বহুসংখ্যক শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন। সমাজবিজ্ঞানে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশগুলোয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে পড়াশোনার জন্য উন্নত দেশগুলো শিক্ষার্থীদের প্রচুর বৃত্তির ব্যবস্থা করে থাকে। তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি, যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ বৃত্তি, অস্ট্রেলিয়ার ইউএনএসডব্লিউ বৃত্তি অন্যতম।
সমাজবিজ্ঞানে ক্যারিয়ার
সমাজবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করে ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। ক্যারিয়ারের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে উচ্চতর ডিগ্রি, ভাষা দক্ষতা, আইটি দক্ষতা ও সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতানুযায়ী এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থা ও মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়তে বেশ অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। সমাজবিজ্ঞানীরা দেশে-বিদেশে তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজকর্মী হিসেবেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে থাকেন।
চাকরির ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানের ডিগ্রিধারীদের জন্য রয়েছে বিশেষত সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, দাতব্য ও বেসরকারি সংস্থায় পেশাগত কাজের সুযোগ। পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক, দেশীয় ও স্থানীয় এনজিওগুলোর বিভিন্ন ইউনিটে চাকরির সুযোগ। এ ছাড়া সামাজিকবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যথা- ইউএনডিপি, ইউনেসকো ও ইউনিসেফেও চাকরির সুযোগ পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক স্কেলে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রাপ্ত হন। এ ছাড়া সাধারণত সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারীদের জন্য বিসিএস, ব্যাংকিং সেক্টর, বিভিন্ন প্রাইভেট ফার্ম, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রায় সব সরকারি চাকরির দুয়ার তো উন্মুক্ত থাকছেই। বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী যারা শিক্ষকতার মহান পেশায় আসতে চান তাদের জন্যও রয়েছে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাজের ধরন
সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা সামাজিক সেবা প্রদান, পরিচালনা, উন্নয়নশীল নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকে। তারা বিভিন্ন গবেষণা, উন্নয়ন প্রোগ্রাম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধীনে গবেষক, সহকারী গবেষক, পর্যবেক্ষক, মাঠ গবেষণা পর্যবেক্ষক, তথ্য সংগ্রহকারী এবং গবেষণা প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করতে পারেন।
সর্বোপরি আন্তর্জাতিক চাহিদা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসে যেকোনো সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, ভাষা দক্ষতা, তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগের দক্ষতা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
কলি