
সময়ের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে থাকা একজন আলোকমানবীর নাম নভেরা আহমেদ। একবুক অভিমান নিয়ে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে সুদূর প্যারিস চলে গেলেও তিনি বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম অগ্রদূত এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশি আধুনিক ভাস্কর ছিলেন।
নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য তৈরির প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল নারীর প্রতিমূর্তি। সাধারণত ভাস্কর্যশিল্পে আমরা নারীর যে প্রেমময় রূপ দেখি নভেরার সৃষ্টি সেখানে অনেক বেশি দৃঢ় ও ঋজু। তার চরিত্রের স্পষ্টতাই বারংবার প্রকাশ পেয়েছে তার নির্মাণে। তার সমকালীন পুরুষশিল্পীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী ভাস্কর। কাজ করতে করতে একসময় নভেরা বুঝতে পারেন তার কাজ বা যোগ্যতার চেয়ে তার নারী পরিচয়টাই প্রাধান্য পাচ্ছে সবখানে। তখন থেকেই নভেরা তার সম্পর্কে যেকোনো আগ্রহকেই অনধিকার চর্চা ভাবতেন। অনেকটা অন্তরালে থেকেই কোনো প্রত্যাশা বা স্বীকৃতি আশা না করে নিজের মনে কাজ করে গেছেন। সে কারণেই ইতিহাসে নভেরা আহমেদ একজন রহস্যে ঘেরা অধরা শিল্পী।
নভেরার জন্ম বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে ২৯ মার্চ, ১৯৩৯ সালে। বাবার চাকরি সূত্রে ছোটবেলা কেটেছে কলকাতায়। নাচ আর গানের পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই মাটি দিয়ে মূর্তি গড়তেন। ১৯৫০ সালে আইনশিক্ষার জন্য লন্ডনে গিয়ে ভাস্কর্যশিল্পের প্রতি প্রেম বাড়তে থাকে তার। এরপর ১৯৫১ সালে নভেরা ভর্তি হন লন্ডনের ‘ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস’ এর ‘মডেলিং ও স্কাল্পচার’ কোর্সে। শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৬ সালে জুন মাসে দেশে ফিরে আসেন। সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তার স্নেহধন্য দুই শিষ্য হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদকে শহীদ মিনারের ডিজাইনের দায়িত্ব দেন। সেই নকশা নভেরা এবং হামিদুর রহমান দুজনে মিলেই করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে সেই কাজ শেষ হলেও মূল নকশা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এবং দুঃখজনকভাবে স্থপতি হিসেবে শহীদ মিনারের প্রাথমিক দুই নকশাকারের একজন নভেরা আহমেদের নাম ইতিহাস থেকে বাদ পড়ে যায়। এর কিছুদিন পরেই নিজ ভূমি, স্বজন সব পেছনে ফেলে ফ্রান্স চলে যান তিনি। জীবদ্দশায় কখনো আর দেশের মাটিতে পা রাখেননি। বাংলার দর্শক নভেরাকে আর কোনো দিন দেখেনি। এমনকি সচেতনভাবে দেশের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ করে দেন।
১৯৬১ সালে ভাস্কর হিসেবে জাতীয়পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন নিজের অস্থিত্ব জানান দিয়েছিলেন দৃঢ়চেতা এই নারী। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার অ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনামে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া নভেরার ছয়টি ভাস্কর্যের মধ্যে চাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার নভেরা আহমেদকে একুশে পদক দিলেও তিনি গ্রহণ করেননি। দেশের প্রতি তার অভিমানের পাহাড় এতই বড় ছিল যে, দেশ ত্যাগের পর তার জীবদ্দশায় তিনি দেশের কোনো মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার বা তার কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। তবে, ১৯৯৯ সালে প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী তাকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে একুশে পদক প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর কথা বললে অবশ্য তিনি রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু এর পরই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে তা আর হয়ে ওঠেনি। ২০১৫ সালে প্যারিসের ওথ ইল শহরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। সরকারিভাবে আজ পর্যন্ত ভাস্কর নভেরা আহমেদের প্রাপ্য একুশে পদক তাকে বা তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
নভেরা আহমেদের কাজের বেশকিছু সংগ্রহ রয়েছে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। এ ছাড়া প্যারিসে তার স্বামী গ্রেগরি দ্য ব্রুনোর স্টুডিওতে ৯টি ভাস্কর্য ও ৪৩টি অঙ্কিত চিত্র রয়েছে। বর্তমানে বাংলা একাডেমির একটি হলের নাম নভেরা হল।
মোহনা জাহ্নবী